চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সিডও সনদ ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সরকার আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৪ সালে সিডও সনদের অনুমোদনকারী রাষ্ট্রসমূহের একটি হিসেবে স্বাক্ষর করে। নারীর প্রতি বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, রীতিনীতি, প্রথা ও চর্চা নিষিদ্ধকরণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদানকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে আসা জরুরী। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের এবং জনসাধারণের কল্যাণার্থে সিডও সনদ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী।

সিডও সনদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্ব প্রথম জনগণের হাতে পৌঁছে দিতে সিডও সনদ বাংলায় অনুবাদ করে। সিডও সনদ হচ্ছে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক দলিল বা চুক্তি। যুগ যুগ ধরে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে নারী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রেখে চলেছে সেই ভূমিকা ও অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি দান, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণসহ মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য অনুকূল সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি চুক্তি।

১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এটা কার্যকর হতে শুরু করে।“Convention on the Elimination of All forms of Discrimination against Women” – (CEDAW) বাংলায় বলা হয়েছে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সাধন। এ পর্যন্ত ১৮৫ টিরও বেশি দেশ সিডও সনদ গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৬০ টি দেশ সিডও সনদের ধারাগুলো তাদের জাতীয় সংবিধান ও আইনে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

সিডও সনদের মূলে আমরা দেখতে পাই

মানব সমাজ, সভ্যতা বিকাশ ও উন্নয়নে যুগ যুগ ধরে নারীরা যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান।

সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমস্ত বিশ্বের শান্তির ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরষের মধ্যে সমতা স্থাপন।

মানুষ হিসেবে নারীর উন্নয়ন ও বিকাশের প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করার জন্য আইন প্রণয়ন।

প্রচলিত আইনের সংস্কার এবং আইন প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি তথা প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপন।

নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান।

এই মূল কথাগুলোকে ধারণ করে তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সিডও সনদ; সমতা নীতি, বৈষম্যহীনতার নীতি এবং শরিক রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের নীতি।

সিডও সনদে ৩০ টি ধারা রয়েছে। নারীর জীবনে মাবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর অগ্রগতি ত্বরান্বিতকরণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে সহায়ক। এই ধারাগুলো তিন ভাগে বিভক্ত।

১ থেকে ১৬ ধারা: নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ আলোচনা করা হয়েছে।

১৭ থেকে ২২ ধারা: সিডও এর কর্মপদ্ধতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের দায়িত্ব বিষয়ক।

২৩ থেকে ৩০ ধারা: সিডও প্রশাসন সংক্রান্ত।

১ থেকে ১৬ ধারা সিডও সনদের মূল ধারা। এই ধারাগুলি সহজ ভাষায়।

ধারা- ১: নারীর প্রতি বৈষম্যের ব্যাপক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং বৈষম্যের সংজ্ঞা প্রদান।

ধারা – ২: বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা স্থাপনের নীতিমালা গ্রহণ।

ধারা – ৩: নারীর মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।

ধারা – ৪: নারী-পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সমতা আনায়নে সাময়িক ও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।

ধারা – ৫: নারী-পুরুষের প্রচলিত ভূমিকা ও কর্মকান্ডভিত্তিক নেতিবাচক সংস্কৃতি পরিবর্তন।

ধারা – ৬: পতিতাবৃত্তি দূরীকরণে আইনসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।

ধারা – ৭: রাজনীতি ও জনজীবনে সর্বত্র নারীর অংশগ্রহণের সমধিকার নিশ্চিতকরণ।

ধারা – ৮: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধি রূপে নারীদের প্রেরণ।

ধারা – ৯: নারী জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ধারা – ১০: সকল ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ধারা – ১১: চাকুরি, কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ধারা – ১২: নারীর জন্য মাতৃত্বকালীন পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিচর্যাসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান।

ধারা – ১৩: অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ।

ধারা – ১৪: পল্লী নারীদের উন্নয়ন এবং তাদের সমঅংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা।

ধারা – ১৫: নারীর আইনগত ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ধারা – ১৬: বিয়েসহ সকল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমধিকার প্রতিষ্ঠা।

সিডও ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদের মধ্যে- অন্যতম। এই সনদ জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত। তাই বাস্তবায়নের সব দায়-দায়িত্ব হলো অনুমোদনকারী সকল রাষ্ট্র বা সরকারের। সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন। এই সনদে রাষ্ট্রীয় মূল দায়-দায়িত্বগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দায়-দায়িত্বের মধ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক নারীর প্রতি বৈষম্যহীনতার নীতি রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ঘোষণা করা। বাংলাদেশ সিডও সনদের চারটি ধারা সংরক্ষিত রাখা। ক্রমাগত নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের দাবীর ফলে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে সিডও সনদের ধারা ১৩(ক) এবং ১৬-১(চ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে। কিন্তু সিডও সনদের ধারা ২ এবং ১৬-১(গ) এখনও সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি।

১৯৯২ সালে ৩ সেপ্টেম্বর সিডও সনদ কার্যকর হওয়ার দশম বার্ষিকী পালিত হয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্রের যৌথ আয়েজনে। সভায় গ্রহীত প্রস্তাবে নারীর অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের এই সনদকে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি ও অনুমোদনের জন্য দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশে নারী সমাজের অবস্থা ও মর্যাদা নিরূপণে একটি কমিশন গঠনেরও দাবী জানানো হয়। যা আজও দাবি হিসেবেই রয়েছে, বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ বাংলাদেশ ৪টি ভয়াবহ সমস্যা এখনও বিরাজ করছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাতৃ মৃত্যুহারের দেশ।

বয়স্ক নারী স্বাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় কম।

নারীর গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় কম।

নারী নির্যাতন সহনীয় মাত্রার উর্ধ্বে।

এছাড়াও সিডও সনদে যে অধিকাংশ ধারা সরকার অনুমোদন করেছে সেগুলোর বাস্তবায়নও খুবই দুর্বল। সিডও কমিটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসন ও নারী নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে গৃহীত ইতিবাচক আইন-নীতিমালা এবং কার্যক্রমের প্রশংসা করার পাশপাশি সঠিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সর্ম্পকে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। এই ক্ষেত্রে সিডও সনদের দুইটি ধারার ২ নং এবং ১৬-১(গ) সরকারের সংরক্ষণ বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ২ নং ধারাকে বলা হয় বা সনদের প্রাণ। যে ধারায় নারী প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা গ্রহণের উপর জোর দেয় হয়েছে এবং ধারা ১৬-১(গ) তে বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান অবস্থা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরষের একই অধিকার থাকবে। বাংলাদেশ সরকার এই দুইটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহারের স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে না। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়ত আইনের বিরোধী বলে আপত্তি জানাচ্ছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পবিত্র কুরআনের আইন অনুসারে পুরোপরিভাবে পরিচালিত নয়। তাছাড়াও পবিত্র কুরআনে নারীকে সম্পত্তি দানের কথা বলা আছে। কোথাও কি আছে নারীকে নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক দিও না? এমন কোনো কথা বলা নেই। সরকার কেন কুরআন-সুন্নাহর দোহাই দিয়ে চলেছে তা সচেতন নাগরিকের বোধগম্য নয়? জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, মালদ্বীপ, ওমান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্কসহ অনেক মুসলিম দেশ ২ নং ধারায় কোনো আপত্তি না রেখেই সিডও সনদ অনুমোদন করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ১০, ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ ধারায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নারীর মানবাধিকার। নারী-পুরুষর সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদ সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং অনুমোদন অপরিহার্য।

আইন কমিশনের পক্ষ থেকে গত বছর আইন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হলেও এ দুটি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আইন কমশিনের সুপারিশ হচ্ছে বাংলাদেশ বলতেই পারে যে সনদের  দুটি ধারা থেকে শর্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। ধারা দুটির শর্তাবলী প্রয়োগে বাংলাদেশ তার সংবিধান ও প্রচলিত আইনের বিধানবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করবে। বাংলাদেশের নারী সমাজ এবং সচেতন নাগরিকগণ উদ্বেগের সঙ্গে অপক্ষোয় রয়েছে কখন সিডও সনদ পূর্ণরূপে আপত্তিমুক্ত হয়ে বৈষম্যমূলক ব্যবধান ঘুচাবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)