‘বর্তমান সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাই সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নতুন নির্বাচন গঠনে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সকল রাজনৈতিক দল আস্থা রাখবে। সংবিধান মেনে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আমরা চলতি মেয়াদের তিন বছর অতিক্রম করলাম। আমাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে’।
নতুন নির্বাচন গঠনে রাষ্ট্রপতির নেয়া উদ্যোগে আশাবাদী শেখ হাসিনা বলেন,‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন।আমরা আশা করি সকল রাজনৈতিক দল মহামান্য রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখবেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিবেন এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবেন’।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হওয়ায় অবৈধ পথে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে বলেন তিনি। তবুও গত নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। এতে রাজী না হয়ে উল্টো সন্ত্রাসীদের দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করায় বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সরকার প্রধান।
সাম্প্রতিক সময়ের নতুন সমস্যা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। যারা ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় তাদের ঠাই বাংলার মাটিতে হবে না’।
জঙ্গিবাদ রুখতে ইমাম, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, স্থানীয় মুরুব্বি এবং অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় দেয়া ভাষণের শুরুতেই জাতিকে নতুন বছর ও বর্তমান মেয়াদের ৩ বছর পূর্তির শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। স্মরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ ও নির্যাতিত ২ লাখ নারীকে ।
একে একে ৭৫ এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার নিজের পরিবারের সদস্য, ২১ আগস্টের শহীদ, বিএনপি-জামাত জোটের সময়ে নিহত দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এবং সম্প্রতি নিহত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার টানা ৮ বছর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন করে ৯ম বছরে পা রাখছে। এই সময়ে জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে তা বিচারের ভার জনগণের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তবে তিনি বলেন, ‘আট বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ’।
দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সরকারের অর্জন, উন্নয়ন পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরেন।
অর্থনৈতিক অর্জন:
জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। জানান, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ৫ টি দেশের একটি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাত থাকলে আগামী বছর জিডিপি হবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
বহুজাতিক কর, নিরীক্ষা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস (পিডব্লিউসি) এর বরাত দিয়ে তিনি জানান,২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯ তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩ তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ।
পরমাণু ক্লাব, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ও পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার:
সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সংশয় দূর করার বার্তা ছিলো আজকের ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেন,‘আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। পরমাণু ক্লাবে যুক্ত হতে যাচ্ছি। রূপপুরে ২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে’।
স্বাস্থ্যকার্ড:
স্বাস্থ্যখাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান,অচিরেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ১ লাখ পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ করা হবে এবং পর্যায়ক্রমে সারাদেশে সব দরিদ্র পরিবারকে এই কার্ড দেয়া হবে।
অন্যান্য খাতে সরকারের সাফল্য:
খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাস্তবায়ন, তৃণমূলের আবাসন, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নেয়া উদ্যোগ ও সাফল্যগুলো তুলে ধরেন তিনি।
জানান, হিজড়া এবং বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ৬’শ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। চা শ্রমিকদের জন্য অনুদান ৫ কোটি বাড়িয়ে ১৫ কোটি করা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেসব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই সেসব জেলায় একটি করে সরকারি অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরপর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সরকারের নেয়া উদ্যোগ এবং মেগাপ্রকল্পগুলো তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। জানান পায়রা বন্দরের রেল সংযোগ, ২০১৮ সাল নাগাদ ৪ টি নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ এবং মাদারীপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণ সমীক্ষা শুরুর কথা।
প্রযুক্তি, গণমাধ্যম খাতে সরকার:
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ৮ বছরে নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। ইউন্যন পর্যায়ে অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।চলতি বছরের মধ্যেই মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের উদ্দেশ্যে কাজ চলছে’।
সরকার মুক্তবুদ্ধির স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ৪৪ টি টেলিভিশন, ২২ টি এফএম রেডিও এবং ৩২ টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে সরাসরি ও অনুদানের মাধ্যমে অর্থায়নে সহায়তা করেছে সরকার। সাংবাদিকদের জন্য এ পর্যন্ত ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দলমত নির্বিশেষ সবাইকে দেশের উন্নয়নে নিয়োজিত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।