বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই পাকিস্তান আমলে, জনগণকে অর্থনীতির জটিল বিষয় বোঝাতেন এভাবে ‘সরকারের আয় মানে হচ্ছে জনগণের ব্যয় এবং সরকারের ব্যয় হচ্ছে জনগণের আয়।’ তিনি সাধারণের ভাষায় কথা বলতে পারতেন। পাকিস্তানের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এ উপলব্ধি অন্য অনেকের চেয়ে আগে হয়েছিল তাঁর। তাঁর সম্পর্কে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা যে হাজার হাজার প্রতিবেদন জমা করেছে ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চে।
সেখানে বলা হয়েছে সেই ১৯৪৮ সালে তিনি ধান কাটা মজুর অর্থাৎ দাওয়ালদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পূর্ব বাংলার বঞ্চনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলতেন, পাকিস্তানের শোষক শ্রেণির বড় অংশের বসবাস পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা পূর্ব বাংলার কৃষকের উৎপাদিত পাট, তামাক, আখ থেকে প্রচুর উপার্জন করে। কিন্তু এ আয়ের বেশিরভাগ ব্যয় করে পশ্চিম পাকিস্তানে। এ জন্য তিনি উপমা দিতেন এভাবে। ধরা যাক, একটি দুধেল গাই ঘাস খাচ্ছে পূর্ব বাংলার জমিতে, কিন্তু সেটির দুধের বাট পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানের শোষকরা বালতি ভরে দুধ দুইয়ে নিচ্ছে।
এই হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাষা। তিনি বলতেন, সরকার খাজনা-ট্যাক্স, শুল্ক-কর আদায় করে নিচ্ছে জনগণের কাছ থেকে। এভাবে সরকারের আয় হচ্ছে। আর সরকারের এই আয়ের জন্য জনগণকে ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার যখন ব্যয় করে তখন জনগণের আয় হচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সরকার যখন সড়ক বা রেলপথ তৈরি করে তখন জনগণের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিংবা যখন সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়ে চাল বা ভোজ্যতেল কিংবা গম বিক্রি করে করে তখন জনগণের সুবিধা হয়। অন্যদিকে, খাজনা-ট্যাক্সের জুলুম যদি বেড়ে যায়, তাতে সরকারের আয় বাড়ে, কিন্তু জনগণের সর্বনাশ হয়। কত সজ ব্যাখ্যা, লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত মানুষেরও তা বুঝতে সমস্যা হয় না।
বঙ্গবন্ধু পাটচাষীদের দুর্ভোগের কথা সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই বলতেন। চাষ করে কৃষক, কৃষক আসল ফায়দা ওঠায় ব্যবসায়ীরা। তারা কাঁচা পাট রফতানি করে প্রচুর আয় করে এবং সেটা ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডি গড়ে তোলার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের পাটকলগুলোর বেশিরভাগ গড়ে তুলেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পাকিস্তান সরকার মালিকদের নানা সুবিধা দিত।কিন্তু বঞ্চিত হতো এখানের শ্রমিকরা। এ দুর্শশার চিত্র তিনি ষাটের দশকে খুব ভালভাবে তুলে ধরতে পারেন বলেই ৬-দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে শ্রমিকরা দলে দলে অংশ নেয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে পাট শিল্প জাতীয়করণ করেন।
অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়্যারম্যান। তিনি লিখেছেন, ‘যে কোনো জটিল নীতিসংক্রান্ত বিষয় তিনি খুব দ্রুত ধরে ফেলতে ও উপলব্ধি পারতেন। কীভাবে কাজটি করতে হবে, সে সিদ্ধান্তও নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। এটা সবাই জানত। আমার সঙ্গে যদি কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ হতো বা আমাকে যদি কোনো নির্দেশনা দিতেন, তা কয়েক মাস পরও মনে রাখতে পারতেন।’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছ থেকে দেখা, পৃষ্ঠা ৯২]
‘টু ইকোনমি’ ধারণার জন্য সুপরিচিত অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে একাধিকবার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা অ্যাকাডেমিসিয়ানরা যখন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় বসতাম, মনে হতো হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজের সেরা অধ্যাপকের লেকচার শুনছি।’ যিনি জনগণের মনের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারতেন এবং বলার সময় তাদের জন্য বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করতেন তেমনি স্বাচ্ছন্দ ছিলেন শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও গবেষকদের সঙ্গে আলোচনায়।
জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন ও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক ও যোগাযেগ ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য যখন কাজ চলছিল তখন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখায়। অথচ পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণ পরিশোধের দায় পাকিস্তানের (সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান) ওপরেই বর্তায়। এ ব্যাপারে নিষ্পত্তির জন্য পাকিস্তানেরই দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের দ্বারস্ত হওয়া। কিন্তু তা না করে দাতারা বরং বাংলাদেশের ওপর ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। দাতাদের এমন অযৌক্তিক শর্ত পূরণে তিনি রাজী ছিলেন না। এমনকি ঋণ বন্ধ করার হুমকির মুখেও না। তাঁর মতে, দাতারা পাকিস্তানকে ঋণ-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছ থেকে দেখা, পৃষ্ঠা ৮৮-৮৯]
বাংলাদেশের দেশের গ্যাস সম্পদের মালিকানা ছিল শেল-অয়েল এর মালিকানাধীন। তাদের লিজের মেয়াদ ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট শেষ হয়ে যায়। তারা লিজ বাড়ানোর আনুষ্ঠানিক আবেদন করেনি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্যাস ক্ষেত্রগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসেন। এ জন্য ওই কোম্পানিকে ১৮ কোটি টাকারও কম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে তৈরি করা হিসাবে দেখা যায় শেল-অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস সম্পদেও মূল্য ছিল (২০১০ সালে) প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ এখন বিশাল সমুদ্র এলাকার মালিক। তেল-গ্যাসসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে সেখানে, এমনই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনি লড়াই করে বিশাল সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধুুকন্যা শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দশকে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছেন। স্বাধীন দেশ কীভাবে চলবে সেটা বলেছেন ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সামনে রেখে প্রণীত নির্বাচনী ইশতেহারে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন কৃষি-শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এখন আমরা অর্থনীতিতে অনেক এগিয়ে। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি শক্তিশালী। এখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি শক্তিশালী। এ সম্ভাবনা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন বলেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে জনগণকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
এই করোনাকালে বঙ্গবন্ধু যদি থাকতেন, ভাল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অর্থনীতি দেখে নিঃসন্দেহে পরিতৃপ্ত হতেন। তিনি এখন কী এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসতেন? বাংলাদেশের ব্যাংকে এ বছরের জুন মাসের শেষে ১৪ লাখ কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। কিন্তু অন্তত এক লাখ অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখানে প্রতি অ্যাকাউন্টে জমা আছে ১ কোটি টাকা কিংবা তার বেশি অর্থ। ধনবানরা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেনি। তাঁর শোষিত গণতন্ত্রের স্লোগান সমাজের এই অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন এ কঠিন দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য। বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমছে। গ্রাম বদলে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় ২২০০ ডলারের বেশি। কিন্তু ধন বৈষম্য বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু এ সময় ঠিক কী কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন, সেটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
সরকার তার আয় বাড়ালে ব্যয়ও বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে তিনি সংখ্যায় বেড়ে চলা ধনবানদের কাছ থেকে কতটা অর্থ আদায় করতে পারতেন? তিনি তো নিশ্চিতভাবেই জানতেন সরকার তার ব্যয় বাড়াতে পারে কেবল আয় বাড়ালেই। সন্দেহ নেই, সেই আয় বাড়াতে তিনি ধনবানদের কাছ থেকে আরও বেশি শুল্ক-কর ধার্য করতে চাইতেন। বাড়বাড়ন্ত ধনবানরা সেটা মেনে নিতে চাইত না, একটি মহল যেমন পছন্দ করেনি ১৯৭৫ সালের দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা তো তাদেরই সৃষ্টি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)