স্বাধীনতা দিবসের প্যারেড হবে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ভজগতি প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলের বাচ্চারা সবাই ২০ টাকা করে দিয়েছিল একটি পতাকা শোভিত ক্যাপ বা টুপি পাবে বলে। তাদের মনে আনন্দ আর ধরে না। অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল সব বাচ্চাকে টুপি দেয়া হলো, পেলো না শুধু ঋষি সম্প্রদায়ের (চামড়ার কাজ করে যারা) বাচ্চারা। লজ্জায়, দু:খে বাচ্চাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়লো।
অভিভাবকরা যখন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে এরকম আচরণের কারণ জানতে চাইলেন, তখন প্রধান শিক্ষক বললেন- মুচির বাচ্চাদের টুপি পরার দরকার নাই। আর মুচি বাবা-মাকে আমি উত্তরও দিতে বাধ্য নই। পরে এই ঘটনা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে শোরগোল পড়ে যায়। ঋষি সম্প্রদায় একটুও আপোষ করেনি। শাস্তিস্বরূপ প্রধান শিক্ষককে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল সবার কাছে। আর কর্তৃপক্ষ সব শিক্ষককে এই স্কুল থেকে বদলি করে দিয়েছিলেন। দেশে সব শিশুর শিক্ষার সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও দলিত ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের এই আচরণ খুব নতুন নয় এবং খুব অচেনাও নয়।
যশোরের কেশবপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান। অতিথিরা সবাই টেবিল-চেয়ারে বসে খাচ্ছেন। কিন্তু একদল অতিথিকে বসার কোন জায়গা দেয়া হলো না। তাদের জন্য মাটিতে কলা পাতা পেতে দেয়া হলো। মাটির গ্লাসে দেয়া হলো পানি। এই অতিথিরা কলাপাতায় খেয়ে নিজেরাই তাদের এঁটো পাতাটি তুলে নিলেন। এখানেই শেষ নয়, তারপর তারা তাদের বসার জায়গাটি নিজেরাই গোবর দিয়ে লেপে পরিস্কার করে দিলেন এই অতিথিরা কিন্তু কুকুর-বিড়াল নয়, আমাদের পাশে থাকা কিছু দরিদ্র মানুষ- যাদের পরিচয় দলিত/হরিজন।
আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে ছবিগুলো দেখে এবং এই অবস্থার কথা শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এও কি সম্ভব? বাংলাদেশে কি এমন জাত প্রথা প্রচলিত আছে? এখন আমি নিশ্চিত যে এদেশেও জাত প্রথা বেশ ভালভাবেই গেড়ে বসে আছে। সমাজের চোখে এ মানুষগুলো অস্পৃশ্য। এরা সবার সাথে খেতে বসতে পারে না, সবার বাড়িতে ঢুকতে পারে না, সব হাসপাতালে চিকিৎসা পায় না, এদের বাচ্চারা সব স্কুলে ভর্তিও হতে পারে না, হোটেল-রেঁস্তোরাতে বসার চেয়ার পায় না- খাওয়ার জন্য থালা-বাটিও পায় না। এরা মারা গেলে দাহ করা হয় আলাদা শশ্মানে।
আমরা ধরেই নিয়েছি এরা নীচু শ্রেণীর কাজ করবে, পড়াশোনা করবে না, পাশ করলেও চাকরি পাবে না। এরা যে কাজগুলো করে সবগুলোই নীচুমানের ও মর্যাদাহানিকর। তাই একজন স্বাধীন মানুষ হিসাবেও তাদের কোনো অধিকার থাকতে পারে না। এরা সাধারণত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ, মরদেহ সৎকার, চামড়ার কাজ, জুতা সেলাইয়ের কাজ, কাপড় ধোয়া, চা বাগানে কাজ, ঢোল বাজান, শূকর পালনের মতো আরো অনেকধরণের অত্যন্ত জরুরি কাজ করেন।
কিন্তু আমরা তথাকথিত ভদ্রলোকরা মনে করি এরাই সবচেয়ে ঘৃণ্য ও অশুচির কাজ করে। অথচ একবারও ভেবে দেখি না পাড়ায় বা বাড়িতে দু’দিন আবর্জনা নিতে না এলে কী অবস্থা হয়? বাড়ির টয়লেটের পানি ও ময়লা নিস্কাশন কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে কী হতে পারে? জুতা সেলাই, জুতা বানানো, শবদেহ দাহ, চা উৎপাদন, দাইয়ের কাজ, ধোপার কাজ বা সরিষার তেল বানানো- কোন কাজটা আমাদের এই তথাকথিত ‘সুশীল’ কাজের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? তাহলে কেনো এই ঘৃণা, কেনো অসমতা? আর তাইতো খুলনার ফুলতলা বাজারের দলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য ফুলমতি বাঁশফোর যখন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আপনারা সাহেব হবেন, আর আমরা হবো সুইপার,’ ( প্রথম আলো ) তখন আর আমাদের বলার কিছু থাকে না। তিনি জানালেন, তাদের বাচ্চাদের কাছে স্কুলের সামনে দাঁড়ানো চটপটিওয়ালা পর্যন্ত চটপটি বিক্রি করে না। স্কুলে আগে গেলেও সামনের বেঞ্চে বসতে দেয়া হয় না।
ভাবতে অবাক লাগে মানুষগুলোর প্রতি এই অমানবিক আচরণের একমাত্র কারণ নিহিত আছে তাদের জন্মগত পরিচয়ের মধ্যে- এরা হরিজনের সন্তান। ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ণবাদী সমাজ ও ধর্ম ব্যবস্থার মূলেই ‘অস্পৃশ্যতার’ ধারণাটি গেড়ে বসে আছে। দলিত নামে পরিচিত এই গোষ্ঠীটি সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে একদম নিচু জাতের। বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ লাখ থেকে ১ কোটি দলিত বাস করে। এদের অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিছু আছেন মুসলিম ও খৃষ্টান।
একসময় এই অস্পৃশ্য মানুষগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। মহাত্মা গান্ধী এদের ‘অস্পৃশ্য’ নাম ঘুচিয়ে নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘হরিজন’ অর্থাৎ ভগবানের সন্তান। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের সংবিধান প্রণেতা ও দলিত আন্দোলনের নেতা বি, আর আম্বেদকর এই হরিজন নামটি মেনে নেননি। তিনি এদের নাম দেন ‘দলিত’ অর্থাৎ যারা প্রকৃতপক্ষেই নির্যাতিত, নিপীড়িত ও সমাজের হাতে পিষ্ট। বর্তমানে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষগুলো দলিত নামেই সবখানে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন এলাকা যেমন- গোরকপুর, চাপড়া, বিহার, পাটনা, মুজাফারাবাদ, ভাগলপুর, এলাহাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দলিতরা বাংলাদেশে এসেছে বহু বছর আগে। ধরা হয় সবচেয়ে বড় ধরণের এই অভিবাসনটি ঘটেছিল ১৮৫০ এর দিকে।
বর্ণবাদী জাতপ্রথা অনুযায়ী মানুষ ৪টি জাতে বিভক্ত। এদের মধ্যে শুদ্ররাই সবচেয়ে নিচু জাতের। কিন্তু এদের পরেও আরো একটি জাত রয়েছে- যারা দলিত নামে পরিচিত। এদের অন্য যেসব নাম রয়েছে সেগুলোর প্রায় প্রতিটি নামের অর্থই ‘নেতিবাচক’। বর্ণপ্রথার সবচেয়ে ভয়ংকর শিকার এই দলিত জনগোষ্ঠী। এরা সাধারণত হিন্দি, তেলেগু, উর্দু, জব্বলপুরী ও বাংলা ভাষায় কথা বলে।
ঋষি সম্প্রদাযের একজন তরুণ জানালেন, আমাদের দেশে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান জানিয়ে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করা হয়। অথচ ৯০ বছর বয়সী আমার দাদাকে এলাকার মানুষ, এমনকি কম বয়সী যুবকরাও নাম ধরে ডাকে, তুই-তোকারী করে। কারণ আমরা ছোট জাতের। এটা শুধু আমার দাদার বেলায় নয়, আমাদের গোত্রের অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের অধিকাংশ দলিতের বাস খুব ছোট ছোট মাটি, বাঁশ ও বেড়া দিয়ে তৈরি কাঁচাঘরে। একটি ঘরে তাদের থাকতে হয় গাদাগাদি করে। দলিতের জীবন অনেকটাই যাযাবরের জীবনের মতো- নিজেদের বলে কোন জায়গা নেই। কোনো ভূমির মালিকানা নেই। সরকারি জমিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের থাকতে দেয়া হয়। পৌরসভার কাজের সাথে জড়িত যারা, তাদেরই নেই কোনো পৌর সুবিধা। একজন নাগরিক হিসেবে শিক্ষা, খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, চিকিৎসা, শৌচাগার ও পয়:নিষ্কাশন কোন সুযোগ-সুবিধাই পায় না এই গোষ্ঠীর মানুষ।
দলিত শিশুরা অভাব ও অসচেতনতার কারণে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় কম। আর যারাও পায়, তাদের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। যারা আগ্রহ নিয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করান, তাদের বাচ্চারা অনেকেই প্রতিকূল পরিবেশের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। সহপাঠীরা তাদের ‘মেথর’, ‘মুচি’, ‘ছোটজাত’ ইত্যাদি বলে কটুক্তি করে- যা সহ্য করা একটি শিশুর জন্য খুব কষ্টকর হয়। তখন অনেক বাচ্চাই আর স্কুলে যেতে চায় না। কুষ্টিয়ার রীতা রানী বাঁশফোর বলেছিলেন, ‘আমি যখন স্কুলে যেতাম পাড়ার ছেলেরা টিটকারি দিয়ে বলতো- ঐ যে মেথরের ছেরি স্কুলে যায়। আমার মনটা ছোট হয়ে যেতো, কুঁকড়ে যেতাম লজ্জায়। প্রতিবাদ করলে ভোগ করতে হতো আরো অপমান। স্কুলে আমার বান্ধবীও তেমন একটা ছিল না।’ শুধু সহপাঠী নয় শিক্ষকরাও তাদের প্রতি টিটকারি সূচক ইঙ্গিত করে। এমনকি রেজাল্ট ভাল করার পরও দলিত শিশুদের বৃত্তি কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দলিত বাচ্চারা স্কুলে যায় বলে অনেকসময় অন্য বাচ্চাদের অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চায় না।
সবচেয়ে কষ্টের দিকটি হচ্ছে সমাজ তাদের জন্য বিশেষ ধরণের পেশা বেধে দিয়েছে। আর কোনো কাজ যেনো তাদের জন্য নয়। আর কর্মক্ষেত্রে শুধু চাকরিদাতারাই নয়, তাদের ছোট চোখে দেখে সহকর্মী ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরাও। এমনকি সরকারও বিভিন্নক্ষেত্রে এই বৈষম্য টিকিয়ে রেখেছে। সরকার সার্ভিস রুল ও বেতনে বৈষম্য করে দলিতদের হয়রানি করা হয়। ‘ছোটজাত’ অ্যাখ্যা দিয়ে এদের অন্য চাকরিতেও নিয়োগ দেয়া হয় না। অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বৈষম্য দুটি পারস্পরিক জড়িত বিষয়। এখনো মেলামেশার ক্ষেত্রে দলিতরা নিজেদের মধ্যেই বন্দি। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ত্রাণ, সেটাও ঠিকমতো পায় না তারা শুধু দলিত বলে।
ইতোমধ্যে দেশের সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও দলিত, হরিজন মানুষের জন্য প্রণীত বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০১৫ খসড়া সংশোধনীসহ প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন হলে হয়তো বৈষম্যের শিকার মানুষগুলো অনেকটাই ন্যায়বিচার পাবে কিন্তু আদতে বৈষম্য কমবে কতটা? আমাদের মন থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে সবচেয়ে আগে। আর তা দূর করতে না পারলে পুরো মানব সমাজ নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)