দুর্দান্ত এক ম্যাচের সাক্ষী হয়ে থাকল লিডসের হেডিংলি। একপেশে অনেক ম্যাচের পরে অবশেষে একটা খেলায় টানটান উত্তেজনার আঁচ। এই না হলে বিশ্বকাপ! ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের মঞ্চে যে বিধ্বংসী ফর্মে ‘ফেভারিট’ ইংল্যান্ড, তাতে শ্রীলঙ্কার থেকে খুব বেশিকিছু প্রত্যাশিত ছিল না। তবু ফার্নান্দো, মেন্ডিস ও ম্যাথুজের ব্যাটের পর বোলারদের দাপটে ইংলিশদের হারিয়ে বিশ্বকাপকেই জাগিয়ে রাখল লঙ্কানরা। শুক্রবার মরগানের দলের বিপক্ষে ম্যাথুজ-মালিঙ্গারা জিতেছে ২০ রানে।
শুক্রবার লিডসের হেডিংলিতে প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ডকে ২৩৩ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় ১৯৯৬ বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। সেই টার্গেট তাড়া করতে নেমে শেষ পর্যন্ত তিন ওভার বাকি থাকতে ২১২ রানে অলআউট হয় ইংলিশরা।
শ্রীলঙ্কার ২৩৩ তাড়া করতে গিয়ে প্রথম ওভারেই হোঁচট খায় ইংল্যান্ড। ইনিংসের দ্বিতীয় বলে মালিঙ্গা উইকেটের সামনে পা পেয়ে যান বেয়ারস্টোর। আউট! রিভিউ নিলেন বেয়ারস্টো, কিন্তু ক্যামেরা দেখাল আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই ঠিক। এরপর ক্রিজে আসেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জো রুট। প্রবল শক্তিশালী ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপের কাছে ২৩৩ আপাতদৃষ্টিতে কোনো রানই নয়। তবে ম্যাচে থাকতে গেলে দ্রুত আরও উইকেট চাই শ্রীলঙ্কার।
সেটাই হল। টার্গেট বড় নয়, ইনিংসের প্রাথমিক ধাক্কাটা ধীরেসুস্থে সামলে নিচ্ছিলেন জেমস ভিন্স আর রুট। যথারীতি জমাট দেখাচ্ছিল রুটকে, শুরুতে নুয়ান প্রদীপের বলে ব্যাকফুট পাঞ্চে যে চারটা মারেন রুট, তা ছিল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো।
কিন্তু এরইমধ্যেই আউট ভিন্স (১৪)। সপ্তম ওভারে ফের আঘাত হানেন মালিঙ্গা। আউট সুইঙ্গারে পা ঠিক জায়গায় নিতে না পেরে বল ব্যাটের কানায় আলতো চুমু খেয়ে ফার্স্ট স্লিপে তালুবন্দি মেন্ডিসের। রুটের সঙ্গী হন মরগান। সামান্য চাপে পড়ে ইংল্যান্ড, তবে তাদের যে ব্যাটিং শক্তি তাতে তখনও কেউ ভাবেনি কী হতে যাচ্ছে।
বল মুভ করছিল পিচে। এরমধ্যেই দুর্দান্ত রিটার্ন ক্যাচ! আফগানিস্তান ম্যাচের নায়ক ইয়ন মরগানকে অবিশ্বাস্যভাবে আউট করেন ইসুরু উদানা! স্টাম্পের ওপর নিচু ফুল টস খেলতে গিয়ে বোলারের হাতেই ক্যাচ দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরত ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। ২০ ওভারের শেষে ইংল্যান্ডের স্কোর তখন ৭৬/৩, লড়াই ছাড়ছিল না শ্রীলঙ্কা।
তবে অসামান্য সংযমী ইনিংস খেলতে থাকেন জো রুট, নিজের স্বাভাবিক মারকুটে ব্যাটিংকে নিয়ন্ত্রণে রেখে। শান্তভাবেই পঞ্চাশও করেন। অন্যপ্রান্তে বেন স্টোকসও একই রকমে আগান।
বোলিং আক্রমণে ফিরেই ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ জো রুটকে কট বিহাইন্ড করেন মালিঙ্গা! লেগসাইডে কট বিহাইন্ড রুট (৫৭), আম্পায়ার আউট দেননি, কিন্তু রিভিউ চায় শ্রীলঙ্কা এবং রিভিউ তাদের পক্ষে। রুট হয়ে যান বিশ্বকাপে মালিঙ্গার ৫০তম উইকেট।
এরপর আউট হন মঈন আলি। যাকে ‘আত্মহত্যা’ ছাড়া আর কী বলা যায়? প্রয়োজনীয় রানরেট ছয়ের নিচে, বাড়তি ঝুঁকি না নিলেও ম্যাচ মুঠোয়, এই অবস্থায় ছক্কা মারতে গিয়ে লংঅফে ক্যাচ! আলির ফিরতে ফিরতেই ওকস আউট! প্রায় পরমুহূর্তেই আউট আদিল রশিদ! এক ঝটকায় স্কোর ১৭০/৬ থেকে ১৭৮/৮!
স্বাগতিকদের ৫৫ চাই তখনও, হাতে উইকেট মোটে দুই। সব হিসেব উল্টে দিয়ে ম্যাচ ঢলে পড়ছে শ্রীলঙ্কার দিকে। এবারের আসরের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটতে চলেছে? বেন স্টোকস পারবেন একা বৈতরণী পার করতে? উঠতে থাকে এমন প্রশ্ন।
অসম্ভব নয়, কিন্তু কঠিন। এই অবস্থায় আর্চার আউট ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে। একা মাঝি স্টোকস সঙ্গী হারান একের পর এক। একে একে নিভে যায় বাতি। ৪৭ রান বাকি তখন, হাতে এক উইকেট। টিকে থাকতে হবে আরও ছয় ওভার। শ্রীলঙ্কা না জিতলেই এই ম্যাচকে অঘটন বলতে হত তখন।
তবু একা লড়েন স্টোকস। মুহূর্তে মুহূর্তে মোড় ঘুরছিল ম্যাচের। ৪৬তম ওভারে উদানার থেকে আসে ১৫ রান, সৌজন্যে স্টোকসের দুটি গগনচুম্বী ছক্কা! বিপদ তখনও কাটেনি শ্রীলঙ্কার। তাদের চাই এক উইকেট, অন্যদিকে ২৪ বলে প্রয়োজন ৩০ রান। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। এরপর হল মাত্র চার রান। অপরাজিত ৮২ করেও শেষ পর্যন্ত দল জেতাতে পারলেন না স্টোকস। অপরপ্রান্তে মার্ক উড আউট হয়ে যাওয়ায় হারতে হয় ইংল্যান্ডকে।
মালিঙ্গা চারটি, ডি সিলভা তিনটি ও উদানা দুটি উইকেট নেন।
শেষ পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড। একমাত্র পাকিস্তানের কাছে হেরেছিল এবারের আয়োজক দেশ। চমকে দেয়ার মতো পরিসংখ্যান একটাই। চলতি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ১০ ব্যাটসম্যানের মধ্যে পাঁচজনই ইংলিশ। এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত এক ডজন সেঞ্চুরি এসেছে। পাঁচটিই এসেছে ইংল্যান্ড শিবির থেকে।
সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে হলে জয় অবশ্যম্ভাবী। এমন অবস্থায় লিডসে এদিন টস ভাগ্য সঙ্গ দেয় শ্রীলঙ্কাকে। টস জিতে সিংহলিজ অধিনায়ক করুণারত্নে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। টসের পর দিমুথ বলেন, ‘ঘাস আছে বটে, তবে ভালো ব্যাটিং পিচ। প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে রান তুলতে পারলে ইংল্যান্ডকে চাপে ফেলা যাবে।’
শরীরী ভাষায় মরিয়া ভাব থাকলেও মাঠে নেমে প্রথমদিকে কাজে খুব একটা সফল হতে পারলেন না শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। শুরুতে মাত্র ৩ রানে ২ উইকেট খুঁইয়ে এদিন চাপে পড়ে যায় তারা।
সেখান থেকে দলকে কিছুটা টেনে তোলেন আভিষ্কা ফার্নান্দো ও কুশল মেন্ডিস জুটি। অর্ধশতরান থেকে মাত্র ১ রান দূরে আউট হন আভিষ্কা। তৃতীয় উইকেটে মূল্যবান ৬০ রান যোগ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেন কুশল মেন্ডিস ও অভিজ্ঞ আঞ্জেলো ম্যাথুজ।
চতুর্থ উইকেটে এই দুই ব্যাটসম্যানের জুটিতে ৭১ রান ওঠার পর ব্যক্তিগত ৪৬ রানে প্যাভিলিয়নে ফেরেন মেন্ডিস। এরপর জীবন মেন্ডিস রানের খাতা না খুলেই ফেরেন। তবে ম্যাথুজকে কিছুটা সঙ্গ দিয়ে দলের রানকে দু’শোর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন ধনঞ্জয়া ডি’সিলভা।
এরইমাঝে দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে ব্যক্তিগত অর্ধশতরান পূর্ণ করেন সাবেক অধিনায়ক ম্যাথুজ। ৪৩.৩ ওভারে ব্যক্তিগত ২৯ রানে ডি’সিলভা আউট হওয়ার পর টেলএন্ডার ব্যাটসম্যানদের থেকে আর বিশেষ সহায়তা পাননি তিনি। শেষমেষ একক প্রচেষ্টায় দলের রানকে ২৩৩-এ পৌঁছে দেন তিনি।
১১৫ বলে ম্যাথুজের অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংস এদিন সাজানো ছিল ৫টি চার ও ১টি ছয়ে। আর্চার-উড-রশিদের সামলে তার লড়াকু ব্যাটিংই কিছুটা লড়াইয়ের রসদ এনে দেয় দলকে। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৩২ রান তোলে শ্রীলঙ্কা।
ইংল্যান্ডের হয়ে ৩টি করে উইকেট নেন জফরা আর্চার ও মার্ক উড। ২টি উইকেট নেন আদিল রশিদ। ১টি উইকেট পান ক্রিস ওকস।