রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, মুদি দোকান, কাঁচা বাজার, ঔষুধের দোকান, এটিএম বুথ বা বন্ধ হয়ে থাকা শপিং মলের সামনে এখন দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য অসহায় নারী যারা মানুষ দেখলেই সাহায্য প্রার্থনা করছেন। হাত পাতছেন। কেউ গাড়ির দরজা খুললেই সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এসব নারীদের সাথে শিশু সন্তানেরাও রয়েছেন। মায়ের সাথে তারাও করুণ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকছেন কিছু পাওয়ার আশায়। বেশিরভাগ মধ্যবয়সী এই নারীরা কখনই ভিক্ষুক ছিলেন না, ছিলেন শ্রমজীবী। কিন্তু করোনা এক কালো অন্ধকারময় জীবনের সম্মুখীন করেছে এদেরকে।
মধ্যবয়সী এই সব নারীদের পোশাক-আশাক দেখেও কিছুটা আঁচ করা যায় যে তারা এর আগে এভাবে রাস্তায় নামেননি, তারা পেশাদার ভিক্ষুকও নন। এরা শ্রমজীবী নারী- বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন। অনেকটা সামাজিক মর্যাদা নিয়েই তারা জীবনযাপন করতেন। কিন্তু সময়ের ফেরে এখন তাদের পথে নামতে হয়েছে। আলাপ করে জানা গেছে এরা কেউ বাসাবাড়ির গৃহশ্রমিক, কেউ নির্মাণ/মাটি কাটা শ্রমিক, কেউ বিভিন্ন মার্কেটে আলু-পেঁয়াজ বাছাই করা, কেউ হোটেল রেস্টুরেন্টে মশলা তৈরি করা, কেউ বিভিন্ন দোকানে সেলাইশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সামান্য যে বেতন পেতেন স্বামী আর নিজের আয় মিলিয়ে তারা ভালোই চলতেন। অনেকেই আবার বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ায় নিজের আয় দিয়েই কষ্ট করে চলতেন। কষ্ট হলেও মনে শান্তি ছিল এই বলে যে চরম অনিশ্চয়তা বলে কিছু ছিল না। সচল ঢাকা শহরে-অন্তত এই নিশ্চয়তা ছিল যে কিছু একটা কাজ করলেই দু পয়সা আয় করা যেত। দু মুঠো ভাতের সংস্থান করা যেতো।
কিন্তু বিধি বাম! করোনাভাইরাসের কারণে এরকম নিন্ম বা স্বল্প আয়ের এই শ্রমজীবী সংগ্রামী নারীদের জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্বিসহ অবস্থা, ঘোর অন্ধকার। এত দ্রুত ঢাকা শহর তাদের জীবনে এতোটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে কল্পনাও করতে পারেননি। সবকিছু বন্ধ থাকায় এখন আর তাদের কারো কাজ নেই, কেউ ডাকেও না- সবাই বেকার। বাসাবাড়িতে গৃহশ্রমিকরা যেতে পারছেন না। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করতেন তাদের কাজও বন্ধ। চাঁদনী চকসহ বিভিন্ন মার্কেটে যারা সেলাই, ফুলতোলা, জরির কাজ করতেন তাদের কাজ বন্ধ। হোটেল- রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কারণে যে নারীরা মশলা পেষা ও পেঁয়াজ-মরিচ-সবজি কাটার কাজ করতেন তারাও বেকার। যে নারীরা বিভিন্ন বাসাবাড়ি, ফ্লাটে ফ্লোর পালিশ (পয়েন্টিং-কিউরিন)-এর কাজ যারা করতেন তারাও এখন বেকার। গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে সবকিছু বন্ধ থাকায় উপায়ন্তর না পেয়ে এই শ্রমজীবী নারীদের বড় অংশই এখন রাস্তায় নেমে মানুষের কাছে হাত পাতছেন।
শোনা যাক শিউলির কথা। কামরাঙ্গীর চরে বাসা ভাড়া করে থাকেন শিউলি । তার স্বামী অসুস্থ, দু সন্তানের জননী। নিজে কাজ করতেন চাঁদনী চকে একটি পোশাকের দোকানে দর্জি হিসেবে। পোশাক সেলাই, ফুলতোলা এসব কাজ করতেন। দিন হিসেবে মজুরি পেতেন। লেখাপড়াও জানেন তিনি। নিজের আয় করা টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন। প্রতিমাসে ঘরভাড়া তাকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। করোনার কারণে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিউলি মহাবিপদে পড়েছেন। দোকান খুলছে না, কাজ করতে পারছেন না। চোখে তাই অমানিশা। সাহায্য-সহযোগিতা তেমন পাননি। আর এখন তাই তিনি রাস্তায় নেমে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। রাস্তায় অলিতেগলিতে মানুষের কাছে হাত পাতছেন। গাড়ি থেকে কেউ নামলে দৌড়ে যাচ্ছেন। ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের সামনে কথা হয় শিউলির সাথে। সংকোচহীনভাবে নিজের দুঃখের কথা বলেন তিনি। করোনার কারণেই তাকে আজ ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের গৃহশ্রমিক রিজিয়া এর আগে কখনই ভিক্ষাবৃত্তি করেননি। তাজমহল রোডের একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করতেন। প্রতিমাসে বেতন হিসেবে সাড়ে চারহাজার টাকা পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে সেই কাজ আপাতত বন্ধ। রিজিয়া থাকেন ঢাকা উদ্যানে। ষাটবছরের বেশি বয়স তার। সংসারে দুই নাতি রয়েছেন। বৃদ্ধ স্বামীসহ পাঁচজনের সংসার। ন্যাশনাল আইডি কার্ড গ্রামের হওয়ায় কমিশনার অফিস থেকে কোনো ত্রাণ পাননি। কমিশণার অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু আইডি কার্ড দেখার পর ফেরত পাঠিয়েছেন। এ পর্যন্ত যতটুকু খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন তা অচেনা মানুষদের কাছ থেকেই। কী করবেন রিজিয়া? সবকিছু ফেলে রাস্তায় নেমেছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং-এ থাকেন নির্মাণ শ্রমিক রাফেজা। খানিকটা লিকলিকে শরীর তার। দিনমজুর হিসেবে রাস্তার কাজ করতেন। মাটি কেটে ট্রাকে তোলা, খোয়া ভাঙা, রাস্তায় বালু ফেলানো, ইট ফেলানো এই কাজ করতেন। প্রতিদিন পাঁচশত থেকে ছয়শত টাকা দিনমজুরি হিসেবে পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে সেই কাজ বন্ধ। ঠিকাদার বা সরদাররা কেউ এখন তার খোঁজ নেয় না। রাফেজা এখন ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন। প্রতিদিন মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় বিভিন্ন দোকানপাটের সামনে বিষন্ন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মানুষের কাছে সাহায্য চান অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে। বললেন, ‘স্যার, কখনোই ভিক্ষা করতে চাইনি। কিন্তু নিরুপায়। বাসা ভাড়া দিতে হবে। এভাবেই এখন চলছে। আবার কাজ শুরু হলে কাজই করবো।’
গ্রীনরোডের আসমার অবস্থাও একই রকম। জীবনে কোনোদিন ভিক্ষাবৃত্তি না করলেও পেটের দায়ে এখন সেটাই করছেন। আসমা স্বামী সন্তান নিয়ে থাকেন গ্রীণরোডে। স্বামী রিকশাচালক, আর তিনি নিজে গ্রীনরোডের কোয়ার্টাারে বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। স্বামীর পাশপাশি তিনিও মাসে চার থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করতেন। কিন্তু করোনার ছুটির দুদিন আগে স্বামী কিশোরগঞ্জের ভৈরবে গিয়ে আটকা পড়েন। আর ঢাকায় আসতে পারেননি। এদিকে আসমার বাসাবাড়ির কাজও বন্ধ। কেউ এখন আর ডাকছেন না। আসমা এখন দুসন্তান নিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে হাত পাতছেন। সাহায্য কামনা করছেন। আসমরাও একই অভিযোগ। আইডি কার্ড গ্রামের হওয়ার কারণে তারা কোনো ত্রাণ পচ্ছেন না। কমিশনার অফিস থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
ঢাকার রাস্তায় এখন মধ্যবয়সী যে বিপুল নারীদের দেখা যাচ্ছে তাদের সবার গল্পগুলোই এরকম। তারা কেউই এর আগে কখনই মানুষের কাছে হাত পাতেননি, ভিক্ষাবৃত্তির সাথেও জড়িত ছিলেন না। নিজেদের আয় রোজগারের টাকা দিয়েই সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে সবকিছু বন্ধ থাকায় তাদের আয় রোজগারের সব পথই বন্ধ হয়ে গেছে। আর এখন তাই ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ নেই। অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরও ভয়াবহ রুপ নেবে। আরও বিপুল নারী এভাবেই রাস্তায় নেমে আসবে।
কথা সত্য। দিন যত যাচ্ছে ততই এ ধরনের অসহায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে রাস্তায়, অলিতে গলিতে। প্রতিদিনই বাসায় রাস্তার গলি থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে-‘খালা আম্মা কিছু দিবেন।’ এ আওয়াজ, এ আহবান, এক আকুতি কেবলই বাড়ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)