এক. ১৯৮৩ সাল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে এসেছেন। নতুন করে আবার লেখালেখি করার তাড়না ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। সে সময় তিনি একদিন বইমেলায় ঢুকে এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সত্যিই মুগ্ধ হবার মতো দৃশ্য। বইমেলার সেই মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তীতে তাঁর ‘কী কথা তাহার সাথে?’ শিরোনামের লেখায় বেশ মজা করে লিখেছেন, ‘…আমি দেখলাম এক তরুণ যুবা পুরুষকে ঘিরে ভিড় জমে আছে। সবাই তাঁর অটোগ্রাফ নিচ্ছে। উনি কে? নাটক-সিনেমার কোনো অভিনেতা? একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, উনি ইমদাদুল হক মিলন। নভেলিসট। আমি ইমদাদুল হক মিলনের নাম আগে কখনো শুনিনি এবং একজন ‘নভেলিসটের’ অটোগ্রাফ নেবার জন্যে ভিড় হতে পারে এই অভিজ্ঞতাও আমার নেই। আমি তাঁর একটা বই কিনলাম। বই হাতে এগিয়ে গেলাম লেখকের দিকে। যদি অটোগ্রাফ পাওয়া যায়। মিলন আমার হাত থেকে বই নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, নাম? আমি বিনীতভাবে আমার নাম বললাম। মিলন খস খস করে দ্রুত লিখল, হুমায়ূন আহমেদকে অনেক শুভেচ্ছা। ইমদাদুল হক মিলন।
মিলন আমার নামের বানান ভুল করল। সেটাই স্বাভাবিক। আমাকে সে চেনে না, আমার নামের শুদ্ধ ( ? ) বানান জানার কথা না।’
তারপর বাংলা কথা সাহিত্যের এই দুই নক্ষত্র হরিহর আত্মায় পরিণত হয়েছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন এক অভিন্ন হৃদয়- সেকথা সুবিদিত। সাহিত্যের মানুষজন ছাড়াও অন্যরা তাদের দু’জনকে ‘হুমায়ূন-মিলন’ পরিষদ বলে ডাকতেন।
আজ ইমদাদুল হক মিলনের জন্মদিন। তেষট্টি বছরে পদার্পণ করলেন দেশের প্রথম জনপ্রিয়, নন্দিত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। ১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের ‘পয়সা’ গ্রামে জন্মালেও অনেকটা সময় কেটেছে নানী বাড়ি মেদিনীমণ্ডলে, তারপর ঢাকা মানে পুরান ধাকার গেণ্ডারিয়া এলাকার নানান মহল্লায়। বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কেটেছে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়। লেখালেখি, সাংবাদিকতা, প্রবাস জীবনের দুঃসহ যাতনা, ব্যবসায় ধরা খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া – সবকিছুর পরও লেখালেখিকে বেছে নিয়েছেন জীবনের ব্রত হিসেবে। বাংলাদেশে একমাত্র ইমদাদুল হক মিলনই এই দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন যে, লেখালেখি করে সংসার চালানো যায়, বেঁচে থাকা যায়, নিজের অবস্থানকে শক্তপোক্ত করা যায়। মিলনের আগে এ ধরনের দুঃসাহস আর কোনো লেখক দেখাতে পারেননি। এক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ সফল। শুধু তা-ই নয় লেখালেখি করে যে তারকা খ্যাতি অর্জন করা যায়, যশ প্রতিপত্তি আদায় করা যায়; তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।
দুই. ইমদাদুল হক মিলন নানা কারণে আমাদের সাহিত্যের অন্যতম অপরিহার্য লেখক। তিনি তাঁর বহুমাত্রিক লেখায় তাঁর লেখার জগতকে এমনভাবে তৈরি করে নিয়েছেন যেখানে একজন ইমদাদুল হক মিলনের তুলনা কেবল ইমদাদুল হক মিলনই। সাহিত্যের দশ দিগন্তে তিনি তাঁর রচনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিশালসংখ্যক পাঠক তাঁকে দিয়েছে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের তকমা।
একজন ইমদাদুল হক মিলন অনেক ঝড় ঝঞ্জা পেরিয়ে, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আজ নিজের অবস্থা পরিস্কার করে নিয়েছেন। আজকে তাঁর যে অবস্থান সেটা তৈরি করতে তাঁকে কম কিছু যে হজম করতে হয়েছে!
অস্বচ্ছল পিতার টানাটানির সংসার, তার মধ্যে মাঝে মধ্যেই আবার তার চাকরি চলে যাওয়া , পিতার বেকারত্বের সেসব দুর্দিনে বাড়িতে পাওনাদারের তাগাদা- দশজন ছেলেমেয়ে নিয়ে মার দুরাবস্থা এর ওপর আবার নিকটাত্মীয়, লতায় পাতায় জড়ানো দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়দের উৎপাত- সব মিলিয়ে তার ছোটবেলাটা ছিল বৈচিত্র্যময়। বালকবেলা থেকে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা, দারিদ্রের ভয়াবহতা আর সম্পর্কের অদ্ভুত রসায়ন এই লেখকের সামনে খুলে দিয়েছে এক অনালোকিত দিগন্ত। তারপর জীবনের বাঁকে বাঁকে তিনি সঞ্চয় করেছেন অভিজ্ঞতা।
এক জীবনে কতকিছু যে তাঁকে দেখতে হয়েছে!
সেসব কথা এই লেখক লিখেছেন অকপটে কোনধরনের দ্বিধা না করে। ভাগ্যের সন্ধানে ৭৯ সালে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। সেই জার্মান বাস নিয়ে অসাধারণ উপন্যাসও লিখেছেন কয়েকটি। জার্মানি থাকাকালীন দুঃসহ জীবনের কথা অনেকবার বলেছেন তিনি, লিখেছেনও। একবার এক বুড়ো মহিলা লেখককে নিতান্ত গরীব ভেবে যে কাণ্ডটি করেছিলেন সেটি তিনি ভুলতে পারেননি। সে দিনের কথা লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘বাসে ওঠার আগে তিনি আমার হাতে একটা পাঁচ মার্কের কয়েন গুঁজে দিলেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাস চলে গেছে। কয়েন হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। বুড়ো মহিলা আমাকে এতই দরিদ্র ভেবেছেন যে পাঁচ মার্ক ভিক্ষে দিয়ে গেলেন। কয়েনটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলাম আমি।’
এখানেই ইমদাদুল হক মিলন আর দশ জনের চেয়ে আলাদা। অনন্য। জন্মদিনে প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ ইমদাদুল হক মিলনকে শুভেচ্ছা জানাই। ভাল থাকবেন আপনি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)