আরব্য উপন্যাস আলীবাবা চল্লিশ চোরের কাহিনী নিয়ে নৃত্যনাট্য বাদী-বান্দার রূপকথার মনোমুগ্ধকর নৃত্য দিয়ে সাগর পাড়ে পর্দা নামলো চার দিনব্যাপী আর্ন্তজাতিক নৃত্য উৎসব ‘ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯’-এর।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম বারের মতো অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নৃত্য উৎসব এর সমাপনীতে শতাধিক নৃত্য শিল্পীর নানা মুদ্রার নৃত্য উপভোগ করেন অতিথি, পর্যটক ও দর্শকরা।
সোমবার কক্সবাজার কার্নিভাল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনার অনিন্দ্য চ্যার্টাজি ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
২২ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯’-এ প্রতিদিন সন্ধ্যায় কক্সবাজার কার্নিভালে ছিল নির্বাচিত তারকা শিল্পী ও প্রতিশ্রতিশীল তরুণ শিল্পীদের পরিবেশনা।
খ্যাতিমান শিল্পীদের একক প্রযোজনার পাশাপাশি দ্যুতি ছড়িয়েছে যৌথ পরিবেশনাও। যা দেখে মুগ্ধ হন পর্যটক ও স্থানীয়রা।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত আন্তর্জাতিক নৃত্য উৎসব ‘ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯’ এর আয়োজন করে ওয়ার্ল্ড ড্যান্স অ্যালায়েন্স, এশিয়া প্যাসিফিকের (ডব্লিউডিএ, এপি) বাংলাদেশ শাখা নৃত্যযোগ।
সমাপনী দিনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। এতে ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’ ছাড়াও কক্স কার্নিভাল মিলনায়তনে ছিল তাইওয়ানের সুটে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিয়া ইয়ু সু পরিবেশন করেন ‘ব্লোসম’, হংকংয়ের ওয়েই মিং প্যাকের ‘টয়লেট পাম্প’, ভারতের সুমেধা ভট্টাচার্য্যরে ‘সি দ্য সাউন্ড’, যুক্তরাষ্ট্রের মেগান থমসনের ‘থ্রেসহোল্ডস ক্রসড রিকনসিডারেশন’, বাংলাদেশের শাম্মি আখতারের ‘মাইন’, সাধনা ও নাইম খান ডান্স কোম্পানির ‘আলট্রাভায়োলেট’, ইয়াসিন আরাফাতের ‘ডেমোক্রেসি’, ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পী অনীল কুমার সিং ও মোফাস্সাল আলিফের ‘আই অ্যান্ড মাইসেল্ফ’ পরিবেশনা।
এর আগে সকালে কক্সবাজারের মারমেইড ক্যাফে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে আলোচনায় অংশ নেন দেশ-বিদেশের গবেষকেরা। এক অধিবেশনে ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যালের প্রধান কিউরেটর লুবনা মারিয়াম বলেন, ‘এখনই ঠিক করতে হবে কে কী করতে চাই। বিশেষ করে নতুনদের ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’
সেমিনারে ‘সম্পূর্ণতা’ শিরোনামে এক ধারণাপত্রে সোহিনী চক্রবর্তী কথা বলেন ডান্স থেরাপি নিয়ে। সাবিহা ভাসেল কথা বলেন বয়স্ক মানুষদের নিঃসঙ্গতা দূর করতে ডান্স থেরাপির কার্যকারিতা নিয়ে। পেঁচাকুচা নামের এক অধিবেশনে দু’জন তরুণ নৃত্যশিল্পী ভাগাভাগি করেন তাদের নৃত্যে আসা ও টিকে থাকার অভিজ্ঞতা।
নাচ শিখতে আসা বেশিরভাগ শিশু কীভাবে ঝরে পড়ে, বঞ্চিত হয় নৃত্যের মূল আনন্দ থেকে— এসব নিয়েও আলোচনা হয় সেখানে। মঞ্জুলিকা তারা এক কর্মশালায় নাচ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি সংক্রান্ত নানা ধারণা ও প্রস্তাব তুলে ধরেন।
বিষয়ভিত্তিক নানা ধারণা তুলে ধরেন বিশ্বের নানা দেশের নৃত্যশিক্ষকরা। ডব্লিউডিএ, এপির সভাপতি ভারতের ঊর্মিমালা সরকার তার ধারণাপত্রে নাচ নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। দুঃখের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাচ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে রেফারেন্স দেয়ার মতো কোনো গবেষণা বা লেখা নেই। এ বিষয়ে অন্য ডিসিপ্লিনের লোকদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
পরবর্তী অধিবেশনগুলোয় ‘মেডিয়েটিং ড্যান্স’-এ কোরিওগ্রাফির ভাষা, স্থান ও পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন নরওয়ের টোন পারনিল অস্টার্ন। স্ট্রিট ড্যান্সারদের উঠে আসা নিয়ে কথা বলেন ভারতের মেঘনা ভরদ্বাজ। অস্ট্রেলিয়ার সংগীতজ্ঞ ও নৃত্যশিল্পী সিওয়াই গরম্যান এক উপস্থাপনায় তুলে ধরেন আলো ও শব্দের গুরুত্ব।
আন্তর্জাতিক নৃত্য উৎসবের ভেন্যু কক্সবাজারে হওয়ায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে কক্সবাজাররের স্থানীয় সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘এই উৎসব কক্সবাজার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এই নৃত্য উৎসব। আগামী দিনে এই ধরণের অনুষ্ঠান কক্সবাজারে আয়োজন করার জন্য আয়োজকদের আহবান জানান’।
ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনার অনিন্দ্য চ্যার্টাজি বলেন, দু বাংলার এক সাথে একটি নৃত্য দেখে মনে হলো এটি একটি দেশেরই তৈরি। বাংলাদেশ ভারত সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ও এক সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
চ্যানেল আইয়ের নাটক ও টেলিছবি শাখার মহাব্যবস্থাপক শহীদুল আলম সাচ্চু বলেন, এ রকম আয়োজন যত বেশী হবে ততই দেশের সংস্কৃতিক অঙ্গন ভালো হবে। দূর হবে অপসংস্কৃতি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, পর্যটনের উন্নয়নে এ রকম আয়োজনগুলো ভূমিকা রাখে। আমরা এ পর্যটন নগরীকে সাজাতে নানা ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
মাত্রার পরিচালক সানাউল আরেফিন বলেন, আমরা অনেক ঝামেলার মাঝে ও একটি সুন্দর নৃত্য উৎসব উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছি।
‘আলীবাবা চল্লিশ’ চোরের মূল নৃত্যে অংশ নেয় নৃত্যযোগের সভাপতি ও নৃত্যশিল্পী আনিসুল ইসলাম হিরু। তিনি বলেন, আমরা এভাবে নানা সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। তিনি বলেন, এ উৎসবটি কক্সবাজার করার একমাত্র কারণ ছিলো বিদেশিদের কাছে আমাদের পর্যটন শিল্পকে তুলে ধরা।
উৎসবের আয়োজন সহযোগী হিসেবে ছিলো মাত্রা ও চ্যানেল আই, সমর্থন দিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও টুরিজম বোর্ড। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ এ আয়োজনের অ্যাকাডেমিক সহযোগী ছিলো।
গত ২২ নভেম্বর কক্সবাজারে শুরু হয় আন্তর্জাতিক এ উৎসব। উৎসবের চার দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্পন্সর মারমেইড ইকো রিসোর্টে সেমিনার, প্রবন্ধ পাঠ, ধারণাপত্র উপস্থাপন, কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে যোগ দেন বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের দুই শতাধিক শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক ও কোরিওগ্রাফার। এছাড়া এবছর ডব্লিউডিএ, এপি’র বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। আগামী বছর এ সভা অনুষ্ঠিত হবে হংকং বা চীনে।