‘ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এমনটি বলেছিলেন এক সুগভীর আধ্যাত্মিক অনুভবে, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে যদি কথাটিকে ধরি, তবে সেক্ষেত্রেও এর যথার্থ্য তাঁর কর্মসাধনায় খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন বলেছেন আরেক গানে- ‘চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে’, তেমনটি শিল্পের খেলা (ভারতীয় ধর্মদর্শন মতে শিল্প হচ্ছে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ লীলা) খেলতে খেলতেও মাঠে চরে বেড়ানো অবলা প্রাণীদের প্রতিও দায়িত্বপূর্ণ দেখভাল করেছেন তিনি।
পশুচারণক্ষেত্রের সংকট থেকে শুরু করে পশুখাদ্য বৃদ্ধির উপায় ও পশুপাখির প্রতি ব্যবহারবিধি নিয়েও কথা বলেছেন বা শুধু কথা বলেই শেষ করেননি, এ-ব্যাপারে কর্মযোগও ছিল তাঁর। রবীন্দ্র প্রতিভার বহুরেখায় দ্যুতিময়তার এটিও এক বিচিত্র-বিস্ময়কর ধারা, যা আজকের দিনেও আমাদের দিশা দিতে পারে।
জোড়াসাঁকোর বৃহৎ বাড়িতে সেভাবে পশুপালনের মতো স্থূল বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের তেমন সংযোগ ঘটেছিল বলে শোনা যায় না। ব্রাহ্ম পরিবার বিধায় আর দশটি হিন্দুবাড়ির মতো সভক্তি গো-পরিচর্যা হয়তো ছিল না, তবে খাঁটি গোদুগ্ধের প্রয়োজনে বিশাল বাড়ির একদিকে গরুপালন চলতো চাকরবাকরের তত্ত্বাবধানে। সেকালের রীতি অনুযায়ী ছিল ঘোড়ার গাড়ি। বাড়ির মার্কা ছিল হাতি-আঁকা; তাই ঘোড়ার গাড়িতেও ছিল একই তকমা। সে গাড়ি প্রতিদিন বাইরে বেরুক আর না-ই বেরুক, রোজ বিকেলে সহিসেরা আস্তাবল থেকে ঘোড়াগুলো বের করে সামনের উঠোনে চক্রবৎ ঘোরাতো। এসবই রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে দেখে আসছিলেন। বাড়ির অনেকেরই পশুপাখি পোষার শখ ছিল। রবীন্দ্রনাথও শেষজীবন পর্যন্ত তা করেছেন। তবে সেসব শৌখিন বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব; আমাদের অগ্রতম আগ্রহ মানুষের জীবন ও সমাজের অনিবার্য সঙ্গী যে পশু, মানুষের অন্নসংস্থানে বা জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে, যোগাযোগ বা নানা বস্ত্রবস্তুতে যে প্রাণিপ্রজাতি আবহমানকাল ধরে আবশ্যিক উপাদান, তা রক্ষণ-পালন-বর্ধনে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের পরিচয় গ্রহণ।
একথা এখন সর্বজ্ঞাত যে কবি হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি-সুখ্যাতি লাভ করলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তার ছিল বিপুল প্রসারতা, কর্মসাধনা ছিল বহুধারায় প্রবাহিত। বিশেষ করে তাঁর পল্লীসংগঠন প্রয়াস ছিল আধুনিকতা ও অভিনবত্বে প্রোজ্জ্বল। একাজে অনিবার্যভাবেই তাঁকে যে কৃষি নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছে, নানা উদ্যোগ নিতে হয়েছে, সেটিও সকলের জানা। এই কৃষির উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে পশু প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে এসেছে।
মূলত নদীবিধৌত-কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলায় আসার পরই পশুপালন বিষয়ে তাঁর ভাবনার সূত্রপাত। প্রথমত উনি দেখেছিলেন, একসময়ের গ্রামবাংলায় পথে-প্রান্তরে পশুখাদ্যের অভাব ছিল না। এর ইঙ্গিতময় চিত্র আমরা শুরুতেই স্মরণ করেছি। মানুষ যে মমতা দিয়েই গৃহপ্রাঙ্গণে গরুছাগল পালন করতো সেটিও তাঁর চোখে পড়েছে। ছোটগল্প কিংবা ‘ছিন্নপত্র’-এ এরকম ছবি অনেক আছে যে, ‘… নিকানো আঙিনায় বাঁধা গোরু গামলার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে, খড় স্তুপাকার করা রয়েছে’। কিন্তু একসময়ে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন গৃহপালিত পশুগুলো স্বাস্থ্য হারাচ্ছে. কারণ কখন যে পশুচারণ ক্ষেত্র কমে গেছে, অথচ তাদের খাদ্যের বিষয়টি কারো চিন্তার মধ্যেই নেই।
যখন দেশে পোড়ো জমির অভাব ছিল না, তখন চরিয়া খাইয়া গোরু সহজেই সুস্থ সবল থাকিত। আজ প্রায় সকল জমি চষিয়া ফেলা হইল; রাস্তার পাশে, আলের উপরে, যেটুকু ঘাস জন্মে সেইটুকু মাত্র গোরুর ভাগ্যে জোটে, অথচ তাহার আহারের বরাদ্দ পূর্বাপর প্রায় সমানই আছে। ইহাতে জমিও নিস্তেজ হইতেছে, গোরুও নিস্তেজ হইতেছে এবং গোরুর কাছ হইতে যে সার পাওয়া যায় তাহাও নিস্তেজ হইতেছে। (“ভূমিলক্ষ্মী”, ‘পল্লীপ্রকৃতি’)
কৃষির সাথে পশুর যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক সেটি রবীন্দ্রনাথ যথার্থভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। জামাতা নগেন্দ্রনাথকে লিখেছেন, “দেশে গোরুর উন্নতি করা বিশেষ প্রয়োজন। নইলে আর কিছুদিন পরে চাষের ভয়ানক দুর্গতি হবার আশঙ্কা আছে।” পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনের বিখ্যাত অভিভাষণেও রবীন্দ্রনাথ দেশের বর্তমান সমস্যার গুরুতর দিক বলতে গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজ ভেঙে পড়ার দিকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সেখানেও গৃহপালিত প্রাণীর অবস্থা নিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন।
তবে রবীন্দ্রনাথ শুধু বক্তৃতাবিবৃতি দিয়েই শেষ করার লোক ছিলেন না, সম্ভব হলে নিজেও কাজে নেমে পড়তেন। তিনি কৃষিবিদ্যার পাশাপাশি পশুপাখি সম্পর্কিত দেশিবিদেশি প্রচুর বই সংগ্রহ করে পড়তেন। এতে আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান ও পশুপালনবিদ্যা তাঁর অনেকটাই জানা হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজের ও বন্ধুর পুত্রকে এবং জামাতাকে আমেরিকায় কৃষিবিজ্ঞান পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার যুক্তরাষ্ট্র যান ১৯০৬ সালে এবং কৃষিশাস্ত্রের পাশাপাশি গোষ্ঠবিদ্যাও তাঁদের পাঠ্য ছিল। রথীন্দ্রনাথ ১৯০৯ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে আসলে তাঁর জন্যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কৃষিকর্মের ব্যবস্থা করে দেন। সেসময় আমেরিকা থেকে অনেক কৃষিসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির সাথে‘গৃহপালিত পশুর জাব খাবার মতো নানাবিধ ঘাসের বীজ আনা হয়েছিল।’
সন্তোষচন্দ্রের কাজ ছিল মূলত শান্তিনিকেতন আশ্রমে ও পরে তিন কিলোমিটার দূরের সুরুল কৃষিকেন্দ্রে পরবর্তীকালে যা শ্রীনিকেতন নামে পরিচিতি পায়। আশ্রমে যে গোশালা প্রতিষ্ঠা (১৯১০খ্রি.) করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ছাত্রদের খাঁটি দুগ্ধ খাওয়ানোর জন্যে সেখানে প্রথমে গরু দিয়ে পশুপালন কর্মসূচি শুরু করেন সন্তোষচন্দ্র। শুরুতে বাইরে থেকে পাঁচটি গরু এনেছিলেন। ১৪ মার্চ ১৯১০ জামাতা নগেন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছেন:
সন্তোষ পাঁচটি গোরু নিয়ে বোলপুর বিদ্যালয়েই একটি ছোটখাট dairy খুলছে।
বোলপুরে গোরু রাখার বিস্তর অসুবিধে-ঘাস নেই, গোরুর অন্যান্য খাবারও বহুদূর থেকে বেশি দাম দিয়ে আনিয়ে নিতে হয়। তবু দেখা যাচ্ছে লোকসান হবার আশঙ্কা নেই। আরো যদি গোটা দশেক গোরু আনা যায় তাহলে ঐ জায়গাতেই ১৫০/২০০ টাকা মাসে খরচ বাদে পাওয়া যেতে পারে।…এটা বেশ দেখা যাচ্ছে চরের চেয়ে আমাদের দেশে গোরুর ব্যবসা অনেক বেশি লাভজনক। দেশে গোরুর উন্নতি করা বিশেষ প্রয়োজন। …বাংলা দেশের সকল পাড়াগাঁয়েই দুধ ঘি দুর্ম্মূল্য এবং দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে শুধু কতকগুলো মসলাগোলা জল দিয়ে ভাত খেয়ে বাঙালী কখনো মানুষ হতে পারবে?
২ এপ্রিল ১৯১০ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে লিখিত চিঠিতে দেখি পশুদের খাদ্য ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে দুর্ভাবনা পেয়ে বসেছে রবীন্দ্রনাথকে:
আশ্রমকে দুগ্ধ পান করাইবার জন্য সন্তোষ প্রায় হাজার টাকায় পাঁচটা গোরু আনিয়াছে। কিন্তু ভুষি এখানে পাওয়া যায় না-গোয়ালাও নাই-বড় মুস্কিলে পড়া গেছে। ভুষি আপনাদের অঞ্চলে যদি সস্তায় পাওয়া যায় তবে আপনার সাহায্যে আনাইব। দর কত? গোয়ালা ওখান হইতে জন দুই কি পাওয়া যায় না?
শান্তিনিকেতন হতে রথীন্দ্রনাথকে পত্র লেখেন: “যেখানে জলের অত্যন্ত অভাব সেখানকার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার কি একটা গাছ লাগিয়ে ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও বিশেষ ফল পাওয়া গেছে-সেই গাছ গোরুর খাদ্য। গাছটা কি জানলে বোলপুরের জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে।” ডেয়ারির গো-খাদ্যের অভাব মেটাতে বর্ষাকালে পতিত জমিতে নেপিয়ার ঘাস, গিনি ঘাস বপন করা হয়; এলাকার চাষীদের মধ্যে জোয়ার-বজরার বীজ বিতরণ করেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের দেশে আবহমানকাল হতে ঘরের চালে লাগানোর পর অবশিষ্ট খড়টুকুকেই চাষী গরুকে প্রদেয় খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করতো। ভাবতো গরুছাগল পথে-প্রান্তরে চরেই তাদের খাদ্য সংস্থান করবে। কিন্তু সেখানে তারা তা ঠিকমতো তা পাচ্ছে কিনা, সেটি ভেবে দেখবার অবকাশ পায়নি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলাদেশে পশুখাদ্যের জন্যে ঘাস লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমে এলাহাবাদ থেকে অনেক ছাগল আনারও পরিকল্পনা ছিল। এবিষয়ে ১৭ জুন ১৯১০ তারিখে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছেন : “ছাগলের জন্য চিন্তামণি [ঘোষ] বাবুকে কিছু লিখেছ কি? ও আমাদের চাই। এক ট্রাক নিতেও আমাদের আপত্তি নেই।” ২ জুলাই তারিখে চারুচন্দ্রকে আবার কাব্যিক ভাষায় তাঁর মনোভাব প্রকাশ করলেন : “ছাগলগুলি কবে আমাদের শান্তিনিকেতনের তৃণরাজি কবলিত করতে আসবে?”
এই ‘তৃণরাজি’ বা পশুচারণের জন্য সুরুলের জমিদারের কাছ থেকে অল্প মূল্যে ২০০ বিঘা জমি তিনি সন্তোষচন্দ্রকে পাইয়ে দেন। সুরুলের সিংহবাড়ি লেফটেনান্ট কর্নেল ডাঃ নরেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ অন্যত্র এগার হাজার টাকা দাম বলেও ‘সৎকাজে’র জন্যে রবীন্দ্রনাথকে আট হাজার টাকায় দিতে রাজি হন। ১৯১২ সালে এই ক্রয়বিক্রয় সমাধা হয়। পরবর্তীকালে অনেকেই সুরুলের বা শ্রীনিকেতনের পশুপালন প্রজেক্টে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে বলতে হয়, জাপানের কোবে শহরে রবীন্দ্রনাথের মেজবান গুজরাটি বণিক মোরারজির কথা।
এসময় আরেকজন নগেন্দ্রনাথের কথা শোনা যায়, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওহিয়ো ইউনিভার্সিটি থেকে গোপালনবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের জামাতা নগেন্দ্রনাথের সাথে একই জাহাজে ফিরেছিলেন। জামাতা গঙ্গোপাধ্যায়, ইনি চক্রবর্তী; জামাইবাবুর আমেরিকার পড়া শেষ হয়েছিল কিনা প্রশ্ন আছে, ইনি তো ডিগ্রি নিয়েই এসেছিলেন। যাহোক, রবীন্দ্রনাথ এঁর সম্পর্কে জগদানন্দকে উক্ত পত্রে লিখেছেন:
নগেন্দ্রনাথ নামক একজন আমেরিকায় Dairy Farming শেখা যুবক এখানে আসিয়াছেন। তাঁহার অল্প কিছু Capital আছে। আমাদের বিদ্যালয়ের Dairy-র সঙ্গে যোগ দিয়া একটি কম্পানি খুলিবার জন্য আমি তাঁহাকে উৎসাহিত করিয়াছি। তাঁহার ইচ্ছা এই সঙ্গে ওখানে জমি লইয়া গোরুর খাদ্য ও Vegetable Farming করেন। ওখানে যে জমি লইবার কথা চলিতেছিল সেও যদি এই কম্পানি হইতে লওয়া হয় তবে সেটা অনেক কাজে লাগিতে পারিবে অথচ বিদ্যালয়ের এক পয়সা লাগিবে [না]। বিদ্যালয় এই গোরু মহিষ প্রভৃতিতে যে টাকা ফেলিয়াছে সেই পরিমাণ Share বিদ্যালয়ের থাকিবে সুতরাং বিদ্যালয়ের একটা Profit রহিল।
এই পরিকল্পনার পরিণতি সম্পর্কে জানা যায় নি।
তবে সুরুলের কার্যক্রম একসময় বেশ অগ্রগতি লাভ করেছিল, বলা চলে পশুপালন বিষয়ে ভারতবর্ষে এক পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় শ্রীনিকেতন। ম্যালেরিয়ার কারণে সুরুলের যে কুঠিবাড়ি একসময় ত্যাগ করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ-নগেন্দ্রনাথ, তার জঙ্গল-পুকুর পরিষ্কার করে সন্তোষচন্দ্রের তত্ত্ববধানে মুলতানি ও হানসি গাভী, এলাহাবাদি ছাগল দিয়ে পশুপালন কার্যক্রম চলতে থাকে। অবশ্য সন্তোষ ছাড়াও আরও নয়জনকে নিয়ে কৃষিকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক সভা গঠিত হয়েছিল। তবে একথা বলতেই হবে, সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা-পরিচালনা-পরিবীক্ষণ ছিল সবসময়। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণীতেই সেসব প্রমাণ রয়েছে, যা দেখে বিস্ময় জাগে-জগতের আর কোনো কবিশিল্পির মধ্যে এমন কর্মোদ্যোগ দেখা যায় না। তাঁর এই উদ্যোগের সাফল্য ও বিস্তৃতির খবর নানা সূত্রেই মেলে। ১৩২৬ সালের ৭ পৌষ মেলার বিবরণে কালীমোহন ঘোষ জানিয়েছেন : “মেলার এক প্রান্তে কৃষিবিদ শ্রীযুক্ত সন্তোষচন্দ্র মজুমদার মহাশয় একটি গো-প্রদর্শনী খুলিয়াছিলেন। তিনি গো-জাতির স্বাস্থ্য ও উন্নতি সম্বন্ধে নানাবিধ জ্ঞাতব্য বিষয় সাধারণকে বুঝাইয়া দিতেছিলেন।” ১৩২৯-এর পৌষমেলায় : “গোপালন পক্ষীপালন সম্বন্ধেও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি দেখানো হয়। একটি বৃহদাকার বৃষ ও শ্বেত লেগহর্ন মুরগি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।”
সুরুল কৃষিবিভাগ, কৃষিকেন্দ্র ইত্যাদি নামে প্রথম যুগে পরিচিত হলেও সম্ভবত ১৯২৩ সাল থেকে শ্রীনিকেতন নামে পরিচিতি পেতে থাকে রবীন্দ্রনাথের এই কর্মশিক্ষাকেন্দ্র। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ‘শ্রীনিকেতন সংবাদ’-এ দেখা যাচ্ছে:
গোশালায় বর্তমানে ২৪টি গাভী, ২৩টি বাছুর, ৩টি ষাঁড় ও ২টি বলদ আছে, শ্রীনিকেতনের সকলকে দুগ্ধ সরবরাহ করার পরেও প্রত্যহ ৩২ সের দুধ শান্তিনিকেতনে সরবরাহ করা হয়। স্থানাভাবের জন্য একটি নূতন গোশালা নির্মাণ করার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। মুর্গির ব্যবসা সন্তোষজনক। এই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত গোপালচন্দ্র বসু নূতন প্রণালীতে যন্ত্রের সাহায্যে ডিম ফুটিয়ে শাবক উৎপাদন ও তাদের অল্প সময়ে বাড়িয়ে তোলার কাজে সাফল্য লাভ করেছেন। পুরোনো সাদা লেগহর্ন মুর্গিগুলি বিক্রি করে সেই জাতীয় নূতন মুর্গি কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে।
১৯২৩ সালের গোশালা রিপোর্টের ৬ নম্বর কলামে লেখা হয়েছে: “পক্ষীপালনের কাজ ভালই চলছে।” বিশ্বভারতীর ৬ সংখ্যক এই বুলেটিনে শ্রীনিকেতনের কর্মসূচীর দলিলে লেখা আছে: “৮। কৃষি, ডেয়ারি, পশুপালন, পোলট্রি ও কাঠ-তাঁত-চামড়া কামারের কাজের অভিজ্ঞতাকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য ছাত্রদের শিক্ষাদানকে ব্যবহারিক শিক্ষায় (Practical experience) পরিশীলিত করা এবং এর সঙ্গে স্বাস্থ্য-সম্বন্ধীয় কর্মশিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ। এখানে উল্লেখ্য, মুরগিপালন প্রথম দিকে সামাজিক প্রথামতে মুসলমান ও নিম্নবর্ণের ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণের ছাত্রদেরও উদ্বুদ্ধ করে যুক্ত করা হয়, যাঁদের কেউ কেউ নিজেরাই একসময় পেল্ট্রি ফার্মের উদ্যোক্তা বনে যান।
রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে এইসব বিপ্লবী কর্মকাণ্ড করছিলেন, তখন দেশের পরিস্থিতি নিশ্চয় তার বিপরীতমুখিই ছিল, নইলে তিনি এমন ছড়া লিখবেন কেন-
‘বার্তাকু’ লিখে দিল গুজরানওয়ারায়
দলে দলে জোট করে পাঞ্জাবি গোয়ালায়।
বলে তারা, গোরু পোষা গ্রাম্য এ কারবার
প্রগতির যুগে আজ দিন এল ছাড়বার।
আজ থেকে প্রত্যহ রাত্তির পোয়ালেই
বসবে প্রেপরিটরি ক্লাস এই গোয়ালেই।
স্তূপ রচা দুই বেলা খড়-ভুষি-ঘাসটার
ছেড়ে দিতে হবে ওরা ইস্কুলমাস্টার।
হম্বাধ্বনি যাহা গো-শিশু গো-বৃদ্ধের
অন্তর্ভূত হবে বই-গেলা বিদ্যের।
যত অভ্যেস আছে লেজ ম’লে পিটোনো
ছেলেদের পিঠে হবে পেট ভ’রে মিটোনো। (’ছড়া’; ৯ সংখ্যক)
তবে এসময় গরুপালনের ক্ষেত্রে এক বর্বরতা চলতো ফুকুপ্রথা নামে-নল দিয়ে গাভীর উদরে ধুঁয়া দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, যা তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সরকার তা নিবারণের উদ্যোগ নেয়। রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে নিখিল ভারত কৃষি ও গো-উন্নতি বিধায়িনী সমিতির সহকারী সম্পাদক শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র রায়ের নিকট নিম্নলিখিত বাণী প্রেরণ করেন:
‘উত্তরায়ণ’
শান্তিনিকেতন (বেঙ্গল)
জুলাই ১৭, ১৯৩৭
বর্ব্বর ফুকাপ্রথা অত্যন্ত ঘৃণার্হ। আইন প্রণয়নের দ্বারা ইহা অনতিবিলম্বে জোর করিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া উচিত। আমি এ বিষয়ে কৃষি ও গো-উন্নতি বিধায়িনী সভার কার্যাবলী সর্ব্বান্তঃকরণে সমর্থন করি।
(স্বাক্ষর) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(‘রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ : আনন্দবাজার পত্রিকা’ ৩)
অবলা প্রাণীদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রীতির অনেক প্রমাণ চিঠিপত্রে, গল্প-কবিতায় লিখিত আছে। পশুপালনে সেই প্রীতি ও শিল্পবোধ এক সাথে কাজ করেছে। ১৯১০ সালের কথা। পাশ্চাত্য থেকে এক মহিলার শান্তিনিকেতনে আসবার কথা। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে চিঠিতে কন্যা মীরা দেবীকে লিখছেন : “তোরা রান্নাঘর বাবুর্চ্চিখানা গোয়ালঘর প্রভৃতি সমস্ত নিজে বারবার inspect করে সর্বত্রই পরিচ্ছন্নতা ও সুনিয়ম চল্ছে এইটে দেখে নিস্।” ওই চিঠিরই এক অংশে লিখলেন : “আমার সেই বাছুরবেচারা কেমন আছে? তার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তাকে সেইরকম হাতে করে খাওয়াস্ তো? তার শরীর আজকাল সেরে উঠেছে ত ?” এবছরই আরেক চিঠিতে আবার সেই বাছুর প্রসঙ্গ : “তোদের বাছুর ভাল আছে শুনে খুসি হলুম। আমাদের এখানে একটা বড় বলদ এসেছে-সেটা কি সুন্দর তোকে কি বল্ব-সবি তার পিঠে চড়ে-দেখতে ভীষণ-কিন্তু কাউকে কিছু বলে না। নধর শরীরটি-মাঝে মাঝে গিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে আসি।”
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম কার্যপ্রণালীতে (২৭শে কার্তিক ১৩০৯) কর্মাধ্যক্ষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনার অংশবিশেষ ছিল এরকম:
গোশালায় গোরু মহিষ ও তাহাদের খাদ্যের ও ভৃত্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন। …ভৃত্যদের দ্বারা যত অল্প কাজ করানো যাইতে পারে তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। আপনি যদি সংগত ও সুবিধাজনক মনে করেন তবে গোশালার গাভীগুলির তত্তবাবধানের ভার ছাত্রদের প্রতি কিয়ৎ পরিমাণে অর্পণ করিতে পারেন। দুইটি হরিণ আছে, ছাত্রগণ যদি তাহাদিগকে পোষ মানাইতে পারে তবে ভালো হয়। আমার ইচ্ছা কয়েকটি পাখি মাছ ও ছোটো জন্তু আশ্রমে রাখিয়া ছাত্রদের প্রতি তাহাদের পালনের ভার দেওয়া হয়। পাখি খাঁচায় না রাখিয়া প্রত্যহ আহারাদি দিয়া ধৈর্যের সহিত মুক্ত পাখিদিগকে বশ করানোই ভালো। শান্তিনিকেতনে কতকগুলি পায়রা আশ্রয় লইয়াছে, চেষ্টা করিলে ছাত্ররা তাহাদিগকে ও কাঠবিড়ালিদিগকে বশ করাইতে পারে।
এবারে তাহলে রবীন্দ্রনাথের শখের পশুপাখি পালনের কথায় আসি। অনেকরকম পশুপাখিই তিনি পুষেছেন। তাঁর ছোট পশমের মতো তুলতুলে গায়ের দুটি সাউথ আমেরিকান বাঁদর ছিল। এদুটির প্রসঙ্গে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী বলেছেন, “তাদের জন্যে নানারকম ফল আসত নিউমার্কেট থেকে, তারা আরাম করে সেই ফলগুলি খেত। আমার ভারি হিংসে হত তাদের দেখে।” আরো দুটো পোষ্য প্রাণী প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন, “…বাবার কামিনী কুকুরটাও ছিল তেমনি বাবু-তাকে চান করিয়ে, লোমগুলো আঁচড়ে পাউডার আতর মাখিয়ে ছেড়ে দিত। সে আমাদের কেয়ার করত না। বাবামশায়ের সোফার উপর বেশ আরাম করে বসে থাকত, সে ছিল জাপানী পুড্ল। আর হরিণের নাম ছিল গোলাপী, বাগানের কচি ঘাস খেয়ে সে ঘুরে বেড়াত।”
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ শুধু গৃহের প্রাণীই নয়, গাছের পাখি কিংবা রাস্তার কুকুরকেও প্রতিপালন করতেন। তিনি যখন সকালের নাস্তায় বসতেন তখন পাখিপালেরও ভোজ অনুষ্ঠিত হতো। কবিকে প্রাঙ্গণের টেবিলে নাস্তা করতে বসতে দেখলেই পাখিরা তাঁর পাশে আনাগোনা শুরু করতো। আর কবি মুঠি মুঠি ছড়িয়ে দিতেন মুড়ি। শালিক, চড়াই, পায়রার পাশাপাশি কাকও জুটতো। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, “কাকগুলোকে আমার দেখতে ভাল লাগে না, তবু মনে ভাবি দেখতে যেমনই হোক, ও বেচারাদেরও তো কিছু দাবি আছে এই ভোজের সভায়, তাই আর তাড়া দিতে ইচ্ছে করে না” (‘বাইশে শ্রাবণ’, নির্মল কুমারী মহলানবিশ)। নিজ হাতে মুড়ি বা পাখির খাদ্য বিতরণ করতেন আর কাছেই মাটির পাত্রে পাখিদের জন্যে সর্বদা যেন পানি মজুত থাকে-সে ব্যাপারে কড়া নির্দেশ ছিল কবির।
পশুপাখির অবাধ বিচরণই কাম্য ছিল কবির, তবে ময়ূরের মতো পাখিকে তো সবসময় ছেড়ে রাখা যেতো না, সময়বিশেষে চাকরেরা তাদের খাঁচায় পুরতো বা বের করতো। কোমলহৃদয় কবির তাতেও আপত্তি-অনুযোগ ছিল। অবশ্য পোষা ময়ূরদুটোও মনিবের মনের খবর জানতো। তাই চাকরবাকর দেখলেই কবির চেয়ারের পিছনে আশ্রয় নিত। নির্মল কুমারী জানিয়েছেন, অনেকসময় রবীন্দ্রনাথ কোনো এক চাকরকে কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে ময়ূরদের ঐ প্রতিক্রিয়া অতিথিদের দেখিয়ে মজা ও সন্তোষ পেতেন। নির্মল কুমারী আরো জানিয়েছেন যে, কলকাতায় তাঁদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে গেলে সে-বাড়ির পোষা কুকুর পর্যন্ত কারো তাড়া খেয়ে বা শাস্তির সম্ভাবনা দেখলে এই বিশিষ্ট মেহমানের পায়ের কাছে আশ্রয় নিত। পোষা কুকুর শুধু নয়, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরও কবির আনুকূল্য পেতো। শান্তিনিকেতনে এরকম এক কুকুরকে গাত্রবর্ণের সাথে মিলিয়ে কবি নাম দিয়েছিলেন ‘লালু’। কবির খাওয়ার সময় লালু কাছাকাছি এসে রাস্তার দিকে মুখ করে শান্ত হয়ে বসে থাকতো। রবীন্দ্রনাথ যখন তার নাম ধরে ডাকতেন তখনই ঘুরে তাকাতো। কবি পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিতেন। লালু চুপচাপ খেয়ে চলে যেত। ঘটনা বর্ণনা করে কবি বলতেন, “দেখেছো? কত সভ্য কুকুর আমার। ওর কোনোরকম হ্যাংলামি নেই।… একেই বলে আসল আভিজাত্য। সেইজন্যেই তো আমি ওকে এত ভালোবাসি” (‘বাইশে শ্রাবণ’)।
শেষকথা বলি আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে: শিলাইদহে পুত্র রথীন একবার শালিক পাখি মেরেছিলেন আর তাঁর বোটের মাঝিরা শিকার করেছিল চখা। এটা জেনে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের চরে পাখিশিকারের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পিতৃস্মৃতি’)। উনিশ শতকে কলকাতার ধনীদের পশুপাখি পোষা ছিল এক নির্মম বিলাস; নির্মম এই কারণে যে, যখন তারা গড়ের মাঠে বহু টাকায় কেনা বুলবুলি উড়িয়ে দিয়েছে, বহু ব্যয় করে বিড়ালের বিয়ে দিয়েছে, তখন বৃহত্তর নিম্নবিত্তশ্রেণি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে কি পরিশ্রমই না করে গেছে, তারপরও অনাহারে থাকা ছিল অনেকেরই দিনলিপি। জমিদারনন্দন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রম। যদিও জমিদারি কার্যোপলক্ষে এসেই তাঁর পশুপালন চিন্তা ও কর্ম স্বকীয়তা পায়, তবে এই পশুপালন তাঁর কাছে কখনোই শখের বিষয় ছিল না। ধর্মসংস্কারের বশবর্তী হয়ে শুধু বিশেষ পশুর প্রতি ভক্তি দেখাননি, পশু রক্ষা ও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি প্রধানত সাধারণের আর্থিক উন্নতি ও সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্য নিয়ে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছিল, তাঁর শিল্পিজনোচিত দরদি-উদার দৃষ্টি-সে দৃষ্টি মানুষ ছাড়িয়ে সকল প্রাণীর প্রতিই নিপতিত ছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)