‘নাই কাজতো খই ভাজ’ বলে একটা কথা আছে বাংলায়। শেখ সেলিমের হঠাৎ কিছু বক্তব্যে তাই মনে হতে পারে। এখন বিএনপি-জামায়াত না, হঠাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যায় জেনারেল শফিউল্লাহ, জাসদের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার শেখ সেলিম! কারণ কী এর? যেখানে শেখ হাসিনা বলেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া জড়িত, সেখানে তাঁর ফুফাতো ভাই, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমের ভিন্ন অবস্থান!
একজন ফেসবুকে এ নিয়ে মজার একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনার উচিত শেখ সেলিমকে তাড়াতাড়ি আবার মন্ত্রিসভায় নেয়া। ১/১১ পরবর্তি ভূমিকার জন্যে শেখ হাসিনা শেখ সেলিমকে আর মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি। ১/১১ এর সময় শেখ সেলিম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আর্মির লোকেরা সে সাক্ষ্যের রেকর্ড আবার অনলাইনে ছেড়ে দেয়। সেটি এখনো অনলাইনে আছে। সেই স্ট্যাটাসে লেখা হয়েছে, মন্ত্রী না করাতে শেখ সেলিম প্রতিদিন একে তাকে কামড়াচ্ছেন। তাকে মন্ত্রী করলে তার অন্তত এই কামড়াকামড়ি বন্ধ হবে।
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধে যাননি। আবার তিনি ‘স্বাধীনতা তুমি’র মতো একটি অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছেন। শামসুর রহমান বেঁচে থাকতে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধে যাননি এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হতো। কবি তখন এসবের নিরীহ জবাব দিয়ে বলতেন, তিনিও মধ্যবিত্ত স্বভাবের মানুষ একজন। তখন অনেক মধ্যবিত্তের মতো তার সাহসে কুলোয়নি। তাই যুদ্ধে যাননি। জেনারেল শফিউল্লাহ তেমন আরেকজন নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। প্রতি বছর ১৫ আগষ্ট এলেই তিনি আওয়ামী লীগের লোকজনের হাতে একদফা আক্রমণের শিকার হন। অথচ আওয়ামী লীগই তাকে ১৯৯৬’র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিল এবং তিনি এমপিও হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে না পারার দায় স্বীকার করেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কিন্তু শেখ সেলিমরা তখন কী করেছেন? তিনি আহত হয়েছিলেন। কিন্তু এত বড় দল তাদের। তাদের একজনও কী সেদিন প্রতিবাদ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন? না জান বাঁচাতে পালিয়েছিলেন? অন্যের দায় নিয়ে যখন কেউ কথা বলবেন, নিজেদের দায়দায়িত্ব নিয়েও ভাবা উচিত। কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছুঁড়লে সে ঢিল উল্টো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে নিজের কাছে।
জাসদ নিয়ে কথা বলেছেন শেখ সেলিম। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাসদের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আসে। কিন্তু জাসদের উত্থান কী করে, কিভাবে হলো তা নিয়ে বলেন না কেন? ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের পৃথক সম্মেলন ডাকা হয়। দুই সম্মেলনেই প্রধান অতিথি করা হয় বঙ্গবন্ধকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু যদি এর কোনটিতে না যেতেন, বা শেখ সেলিমের ভাই শেখ মনি যদি এটা না করতেন, তাহলে কী এ সংগঠন তখনই ভাঙ্গে? যারা জাসদ গঠন করেন তারা স্বাধীনতার পর জাসদ গঠন না করে যদি আওয়ামী লীগে থাকতেন তাহলে কী ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ পেতেন না? সে দলে যে মাপের নেতারা ছিলেন, সে মাপের নেতারা তখন আওয়ামী লীগে থাকলে কী শেখ সেলিমরা এতোদূর আসতে পারতেন?
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় চার নীতিতে সমাজতন্ত্রও ছিল অন্যতম নীতি। যেহেতু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে বাংলাদেশ হয়েছে, সেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে সে স্বপ্ন অনেকেই দেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় নীতিতে সমাজতন্ত্র রাখলেও পরবর্তিতে মার্কিন লবির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এরজন্যে তাজউদ্দিনের মতো একজন পরীক্ষিত, ত্যাগী সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক চিন্তার নেতাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়! সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা একদল তরুণ নেতৃত্ব স্বাধীনতার পর হালুয়া রুটির ভাগ বাটোয়ারার দিকে না ঝুঁকে গঠন করেন জাসদ। কিন্তু সে উদ্যোগ প্রক্রিয়াটি সফল হয়নি। কারণ জাসদের বেশিরভাগ নেতার ব্যক্তিজীবন সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শনের ধারেকাছেও ছিলো না। আর বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষও কোন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন এসবও সত্য। কারণ প্রেক্ষাপটটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়কালীন। মুক্তিবাহিনী গঠন করে সাফল্য পাবার নজির থেকে তারা হয়তো ভেবেছেন, এভাবে সফল হবেন। কিন্তু তাদের ব্যর্থতায় আবারও প্রমাণ হয়েছে, এক বিপ্লব দু’বার সফল হয় না। আজ কী বিএনপির পক্ষে একটা গণবাহিনী গঠন সম্ভব? জাসদ নেতাদের তখন অনেক বদনাম ছিল। কিন্তু শেখ সেলিমদের মতো অর্থনৈতিক লুটপাটের বদনাম ছিলো কী? কর্নেল তাহের একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার চিন্তায় কৌশলগত অনেক ভুল ছিল। কিন্তু তিনিতো কোন দুর্নীতিবাজ ছিলেন না।
জাসদ নেতাদের অর্থনৈতিক বদনামতো এসেছে জিয়া-এরশাদ আমলে। জিয়ার ‘আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস’ নীতির অর্থনৈতিক টোপে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার মতো অনেকে বিএনপিতে মিশে যান। মাগুর মাছের খামার পেয়ে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা হয়ে যান আ স ম আব্দুর রব! পরবর্তিতে শাহজাহান সিরাজও বিএনপিতে গিয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হয়ে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিচয়ে দুর্নীতিবাজ হতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে যেতে হয়। কারণ এ দুটি দলই ক্ষমতায় যায় বা ক্ষমতায় থাকে।
জাসদের একটি ক্ষয়িষ্ণু অংশ এখন ১৪ দলের পক্ষে সরকারের সঙ্গে আছে। বাংলাদেশে জোট রাজনীতির কদর আছে বলে কেউ ১৪ দল করে, কেউ ২০ দল করে। ১৪ দলে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কোন দল নেই। এ জোটের নেত্রীর নাম শেখ হাসিনা। জোটের ব্যানারে যখন কেউ ক্ষমতায় যায় তখন জোট থেকে এক দু’জনকে মন্ত্রী করা হয়। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু সেভাবে এখন মন্ত্রী। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু আবার এখন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এটা কী তার তথা হাসানুল হক ইনুরও একটি রাজনৈতিক পরাজয় নয়? কিন্তু সবকিছু দেখেশুনে একটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক লক্ষ্যের ঘোষণা দিয়েইতো ইনুরা ১৪ দল এবং মন্ত্রিসভায় এসেছেন। সে ঘোষণাটি হলো আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলধারার শক্তি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর জঙ্গীবাদ নির্মূল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হচ্ছে এবং হওয়া সম্ভব। মঈনুদ্দিন খান বাদলও বলেছেন, তারা পিতার বিরোধিতার কাফফরা দিচ্ছেন।
সেই জাসদ অথবা হাসানুল হক ইনুরা হঠাৎ করে যদি এতোটা অপাংক্তেয় হয়ে পড়বেন তাহলে আওয়ামী লীগের শেখ সেলিমরা এদের নিয়ে ১৪ দল কেন করেছেন? বা ১৪ দল ভেঙ্গে দিচ্ছেন কেন? তারা ১৪ দল সৃষ্টি করেছেন শুধু তাদের জন্যে সারেঙ্গা বাজানোর জন্যে? এ জোট থেকে কাউকে মন্ত্রিত্ব দেবার জন্যে নয়! বিএনপি, জামায়াত, এরশাদ এসব বাদ দিয়ে হঠাৎ জেনারেল শফিউল্লাহ, জাসদ এসব নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শেখ সেলিমকে নিয়ে এখন নানা সরস আলোচনা হচ্ছে! কারণ বঙ্গবন্ধু পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ এ সদস্যটির পারিবারিক বন্ধনসমূহ মোটেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি-নীতি আদর্শের ধারেকাছেও নেই! এদেশের অন্যতম দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, এরশাদের খাজাঞ্চি বলে পরিচিত নাজিউর রহমান মঞ্জুর শেখ সেলিমের ভগ্নিপতি। তার আদরের ভাগ্নে আন্দালিব রহমান পার্থের কাজ হলো শেখ সেলিমের নেত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যু আর ধবংস কামনা করা! ভাগ্নের গ্রেফতার বিপদ দেখা দিলে মামা হিসেবে তিনি তাকে হেফাজত করেন বলে অভিযোগ আছে!
বঙ্গবন্ধু পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শেখ সেলিম তার পুত্রবধূ করে এনেছেন দেশের অন্যতম বিতর্কিত ব্যক্তি রাজাকার মুসা বিন শমসেরের মেয়েকে! শেখ সেলিমের শক্তিতে তার এই রাজাকার বেয়াই এত বেশি বেপরোয়া যে তিনি সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন! ফরিদপুরের এক শহীদ পরিবারের সন্তান প্রবীর শিকদার তখন বেঁচে গেলেও একটা পা হারিয়ে সারা জীবনের জন্যে পঙ্গু হয়ে গেছেন! শেখ সেলিমের বেয়াই যাকে পঙ্গু বানান তাকে সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে তার কৃত্রিম পা লাগিয়ে আনান শেখ সেলিমের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা!এবার আবার সেই প্রবীর শিকদারের গ্রেফতার নিয়ে শেখ সেলিম কিছুই বললেন না! কারণ কান টানতে গেলে যে তার পারিবারিক সম্পর্কটি চলে আসে! উল্টো আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে বসে দলের জেনারেল শফিউল্লাহ, জোটের জাসদকে টার্গেট করতে গিয়ে দুর্নীতিবাজ-রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা মিলিয়ে তার ঐক্যবদ্ধ পারিবারিক ঘরানাটিই উঠে এসেছে!
আবার, শেখ সেলিমের বক্তব্যে সমর্থন দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে নতুন তদন্তের দাবি করেছেন বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন! ইনি এক সময় ডাকসাঁইটে ছাত্রনেতা ছিলেন। ছাত্রদলের নেতৃত্বে পেশীশক্তির কদর বাড়লে রাজনৈতিক গুরুত্ব হারান! এখন আবার একটি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়ে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর জন্যে যে তার বা তাদের দরদ যে উথলে উঠলো! বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়া এবং বিএনপি গঠনকারী নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে আগে তদন্ত হলে কী মানবেন রিপন সাহেব? খুনি ফারুক-রশীদরা বিদেশি রেডিও-টিভিতে ইন্টারভ্যু দিয়ে বলেছে, পুরো খুনোখুনি পর্বে তাদের সঙ্গে ছিলেন রিপন সাহেবদের নেতা জিয়া। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসায়ই কী ক্ষমতায় এসে খুনিদের আশ্রয়, এমপি, বিরোধীদলের নেতা বানিয়েছিলেন রিপনের নেত্রী খালেদা জিয়া? বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসায় দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে খুনিদের বিচার আটকে দিয়ে তাদের ফাঁসি বিলম্বিত করা হয়েছিল? আমাদের নেতারা এমনই যে ওপরের দিকে থুতু ফেলার আগে ভাবেনও না: সে থুতু তাদের গায়ে এসে পড়ে তাদেরই পোশাক নষ্ট হয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)