‘পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতিমধ্যেই আড়াই লাখ বাঙালির লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে। কুয়োর জলে, খানা খন্দে, কচুরিপানার নিচে শিশু সন্তানের চোখের সামনে পচছে পিতা-মাতার লাশ।’
ঢাকা থেকে এভাবেই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন এপির সংবাদদাতা।
শুধু এপিই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম। তারাই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংসতার চিত্র।
তাইতো ইয়াহিয়ার জারি করা ৭৭ নম্বর সামরিক বিধির মাধ্যমে প্রথম রাশ টেনে ধরা হয় গণমাধ্যমের। এটা ছিল কেবল শুরু মাত্র। এরপরই সেই সময়ে শুরু হয় একের পর এক আইন প্রণয়ন। যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে সঠিক তথ্যসংগ্রহ ও প্রকাশ প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশ জেনোসাইড ও ওয়ার্ল্ড প্রেস বইয়ের সম্পাদক ও সঞ্চালক সেই সময়ের পত্রপত্রিকাকে তুলনা করেন বিষ্ফোরকের সঙ্গে। বিস্ফোরক নিয়ে চললে যেমন আইনি বাধার মুখে পড়তে হয়, তেমন পড়তে হতো সেই সময়ে পত্রপত্রিকা নিয়ে চললেও।
লন্ডনের দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বিস্তারিত লেখা জেনোসাইড: ফুল রিপোর্টে তুলে ধরেন সেই সময়ের গণহত্যার অনেক চিত্র।
গণহত্যার স্বরূপ সম্পর্কে লুই হেরেস লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লিখেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞে নেমেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ওই দেশের রাজনৈতিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে হত্যা করা।
এভাবেই দেশের ভেতরের অবস্থা বিশ্ব গণমাধ্যমে তুলে ধরে বেশ কিছু গণমাধ্যম।
সেই সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কথা আসলেই সবার আগে যে নামটি সামনে আসে সেটি সাইমন ড্রিং। ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সে জন্য পাক হানাদার বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের জন্য তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।
সাইমন ড্রিং-ই সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। তিনি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে লিখেন, ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রিকাগুলোর বিশেষ অবদানও উল্লেখ করার মতো। সেই ক্রান্তিকালে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের খবর ছাপতো সংবাদ জাগরণ, গণরাজ, রুদ্রবীণা, নাগরিক জনপদ ইত্যাদি দৈনিক পত্রিকা। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল সমাচার, দেশের কথা, সীমান্ত প্রকাশ ও ত্রিপুরার কথা। প্রথমদিকে এ সব পত্রিকা বাংলাদেশে থেকে পালিয়ে আসা লোকদের স্মৃতিনির্ভর প্রতিবেদন প্রকাশ করতো। পরবর্তী সময়ে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় প্রতিবেদক পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলমান সংবাদ সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হতো।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর নিমর্মতা ও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে এএফপি, পিকিং, দ্য সানডে টাইমস, জাম্বিয়া, সানডে পোস্ট, নাইরোবি, মানিচি, ডেইলি নিউজ, টোকিও, ভারতের দ্য স্টেটসম্যান এবং পৃথিবী বিখ্যাত পত্রিকা টাইমস উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর সিডনি শ্যানবাগ, ইতালির সাংবাদিক ওরিয়ানা ফেলাচি, ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভিসহ আরও অনেক বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. গোলাম রহমান বলেন, ‘শুরুটা তো হয়েছিল রেইডের মধ্যে দিয়ে। তার আগেও বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ হয়েছে, তবে সেসবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। ইউনিভার্সিটি, আবাসিক হলসহ বিভিন্ন জায়গায় রেড চালানো হয়েছিল তখন। ওই সময় অনেক সাংবাদিক ঢাকায় ছিলেন, শেরাটনে ছিলেন। তাদের অনেককে বাধ্য করা হয় চলে যেতে। তবে কেউ কেউ থেকে যান। তারাই পরবর্তীতে সামনে নিয়ে আসেন নৃশংসতার চিত্রগুলো। বিভিন্ন মাধ্যমে তারাই সংবাদ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ২৫শে মার্চে যে ঘটনাটা ঘটলো এরপরেই সেগুলো মিডিয়াতে এসেছিল। অনেক চাপ ছিল। ফলে অনেকেই চুপ ছিলেন তবে কেউ ছিলেন যারা এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করেন।
গোলাম রহমান যোগ করেন, আন্তর্জাতিক মাধ্যমের তখন দেশে অ্যাকসেস ছিল না। তাই দেশের মানুষের তেমন কোনো গণসচেতনার জায়গা ছিল না। শুধু ছিল রেডিও। লুকিয়ে লুকিয়ে রেডিও শুনতো। এই কারণে দেশের লোকজনের স্পষ্ট কোনো বোঝার জায়গা ছিল না। রেডিও অনুষ্ঠানগুলোই সচেতনতা তৈরি করতে সহায়তা করতো। ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দেশের মানুষেকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি।
তবে বিশ্ব গণমাধ্যমই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের চিত্র। তাই এটা প্রভাবিত করেছিল পুরো বিশ্বকেই।