কিছুদিন পরেই ডাক্তার হয়ে বের হয়ে যিনি মানুষের জীবন বাঁচাতেন, তিনি এখন জীবন নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে আছেন। প্রতিপক্ষ গ্রুপের বর্বর হামলায় গুরুতর আহত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিকুল ইসলাম। গত চার দিনেও জ্ঞান ফেরেনি তার। কখন ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কিনা সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না ডাক্তাররা।
যে সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, সে সন্তানেরই এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় যেন অথৈ সাগরে পড়েছে পরিবারটি। পঞ্চাশোর্ধ বাবা-মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। জমা কোন অর্থও নেই, যা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করাবেন। গত চারদিনেই হাসপাতালের বিল এসেছে ৫-৬ লাখ টাকার মত। যার প্রায় পুরোটাই ধার দেনা করে সংগ্রহ করতে হয়েছে। বাকি টাকা সংগ্রহের উপায়ন্তর না দেখে মানুষের কাছেও সাহায্য চেয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত এ পরিবারটি।
তৌফিকের বড় ভাই সাইদুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আপনাকে আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না, কী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে আমাদের পরিবার। তৌফিকের এ অবস্থা শোনার পর থেকে বাবা মা বারবারই জ্ঞান হারাচ্ছেন। কী হবে না হবে ভেবে উঠতে পারছি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক এবং আইবিএ’র স্নাতকোত্তর সাইদ বলেন: আমার বাবা একজন ছোট ব্যবসায়ী। সারাজীবন যা উপার্জন করেছেন তা আমাদের পড়াশোনার পেছনেই ব্যয় করেছেন। জমা কোন অর্থই নেই আমাদের। পড়াশোনা শেষ করে আমি মাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। গত কয়েকদিনেই প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার মত ব্যয় হয়ে গেছে; যার প্রায় পুরোটাই সংগ্রহ করতে হয়েছে ধার-দেনা করে।
‘‘কিন্তু গত চারদিনেও ওর জ্ঞান ফেরেনি। কবে ফিরবে সেটাও বলতে পারছেন না ডাক্তাররা। তারা শুধু বলছেন, তৌফিকের বয়স যেহেতু কম, তাই সারভাইভ করলেও করতে পারে। এখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া উপায় নেই।’’
সবগুলো পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে আগামী নভেম্বরেই পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার হয়ে বের হতেন তৌফিক। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান তৌফিক। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। বড় দুই ভাই সদ্য পড়াশুনা শেষ করেছেন। ছোটবোন পড়ছেন সম্মান তৃতীয় বর্ষে।
ছোটবেলা থেকেই কৃতিত্বের সাক্ষর রাখা তৌফিক ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে পেয়েছেন মেধাবৃত্তি। এরপর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পরিবারের স্বপ্ন পুরণ করতে ভর্তি হন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে। এমবিবিএস’র চারটি প্রফ’র মধ্যে তিনটি তিনি পাশ করেছেন। আগামী নভেম্বরে শেষ প্রফ দিলেই তিনি হয়ে যেতেন পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার। এমন মেধাবী সন্তানের জীবনেই আজ নেমে এসেছে ঘোরতর অন্ধকার।
যেভাবে সাহায্য পাঠানো যাবে তৌফিককে
নিচের ঠিকানাগুলোতে তৌফিকের চিকিৎসার জন্য নিচের অ্যাকাউন্টগুলোতে সাহায্য পাঠানো যাবে বলে জানিয়েছেন তার বড়ভাই সাইদ।
ডাচ বাংলা (মোবাইল অ্যাকাউন্ট): ০১৮২৯-৯৬৩৭২৯১(আরিফ) এবং ০১৭৪৯-৭৩৭০৭৫৮ (সাব্বির)। ডাচ-বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট: মো. সাইদুল ইসলাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর: ১০৭.১০১.১২০৩০২ কাওরান বাজার শাখা। এছাড়া বিকাশ থেকে ০১৭২২১০৮০০০ নম্বরেও টাকা পাঠানো যাবে।
সেই রাতের বর্বর হামলার বর্ণনা দিলেন সহপাঠীরা
তৌফিকের কয়েকজন সহপাঠী সেদিন রাতের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রাত তখন দেড়টার মত। হঠাৎই সংঘর্ষ বেধে যায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের হান্নান ও পলাশ গ্রুপের মধ্যে। হান্নান গ্রুপের ছেলেরা হামলা চালায় ড. শাহ আলম ছাত্রাবাসে। রুম থেকে বের হয়েই হামলার মুখে পড়েন তৌফিক। তার মাথায় আঘাত করলে সে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় তার গ্রুপের অন্যরা পালিয়ে গেলে সে একা পড়ে থাকে। আর কাউকে না পেয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছেলেরা দফায় দফায় তৌফিককের মাথায় আঘাত করে। সংঘর্ষের ঘণ্টাখানেক পরে অ্যাম্বুলেন্স আসে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সেও তাকে তুলতে দেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায় দফায় দফায় এ সংঘর্ষ হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হয় ২৩তম ব্যাচের ছাত্র তৌফিকুল ইসলাম। একই ব্যাচের ইরফানুল হক রুপুসহ আরও অন্তত ১৬ জন ছাত্র আহত হয়। তৌফিক ও রুপুকে শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। এরপর অবস্থার অবনতি ঘটলে তৌফিককে এ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়। সেখানেই এখন মৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
কেন এই গ্রুপিং?
শিক্ষার্থী জানায়, আমাদের কলেজে ছাত্রলীগের অনুমোদিত কোন কমিটি নেই। কিন্তু হান্নান ও পলাশ নিজেদের ছাত্রলীগের নেতা দাবি করে গ্রুপিং করে। প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নিজেদের দল ভারি করার প্রতিযোগিতা প্রায় প্রতি বছরই এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়েই কোন না কোন গ্রুপে থাকতে হয়।
৫২ জনকে আসামী করে মামলা
এ ঘটনায় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. জাহাঙ্গীর হোসেন ভূঁইয়া বাদী হয়ে কলেজের বিভিন্ন বর্ষের ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৩৫ জনসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা কোতয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
কোতয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, এ ঘটনায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামি রিয়াদ হোসেন ও সৌমিত্র আচার্যকে গ্রেফতার করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক(নিরস্ত্র) রূপ কুমার সরকার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে এবং বাকী আসামীদের ধরার জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে।