“আমি হিমালয় দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখেছি”
বলেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শারীরিক ভাবেও ছিলেন বিশালাকায় । গড় বাঙালিদের চেয়ে ছিলেন বেশী উচ্চতার। আর তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের চেয়েও বিশাল। যে ব্যক্তিত্বের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল প্রবল প্রতাপশালী পাক জেনারেলদের। এমনকি ১৫ আগস্ট যখন হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হামলা চালানো হয় , সেদিন প্রথম তাঁর মুখোমুখি হওয়া মেজর মহিউদ্দিনকে বলেছিলেন,
— কি চাস তোরা? কোথায় নিয়ে যেতে চাস আমাকে?
তখন মহিউদ্দিন তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস পায়নি। আমতা আমতা করে বলেছিল ,
—- আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে, স্যার।
পাশের রুম থেকে মেজর নূর আর মেজর হুদা এসে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীকে। সর্বমোট ১৮টি বুলেটবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন মহানায়ক, হিমালয়ের চেয়েও বিশাল ছিল যার অন্তর। যে বিশালতা তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে লাখো কোটি বাঙালীর হৃদয়পুরে। বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম ছিলো “খোকা”, সেই খোকা থেকে তিনি একদিন হয়ে উঠেছিলেন “বঙ্গবন্ধু”, জাতির জনক।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর সংগ্রামী জীবন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অসংখ্যবার কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। সর্বমোট ৪,৬৮২ দিন কেটেছে তাঁর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। তবু কখনোই মেনে নেননি পরাজয়। তাঁর হাত ধরেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার নতুন সূর্যের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালী জাতি।
তাঁর দেয়া শ্লোগান “তোমার আমার ঠিকানা , পদ্মা মেঘনা যমুনা ” তে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। অভ্যুদয় ঘটেছিল “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” এর। যে জাতীয়তাবাদের প্রেরণা থেকেই উঠেছিল ৬ দফাতে স্বায়ত্তশাসনের দাবী। যে দাবী পরে গিয়ে পরিণত হয়েছিল “স্বাধীনতা” র এক দফা দাবীতে। আর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তাঁর বজ্রকণ্ঠ হতে উচ্চারিত “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “ বাজিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের মরণঘন্টা। প্রত্যেক ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল প্রতিরোধের দূর্গ।
তাঁর নামেই একাত্তরে গর্জে উঠেছিল মুক্তিসেনার রাইফেল। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে রাইফেল উচিয়ে শ্লোগান উঠতো , “তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।” “স্বাধীন দেশের জাতির পিতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”। যার ভিডিওগুলো আজও রক্তে জাগায় শিহরণ।
কোটি মানুষের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার উৎস এই মহামানব শত্রুও হয়েছিলেন অনেকেরই। ‘প্যায়ারে পাকিস্তানের অখণ্ডতা’ রক্ষায় যারা জান কোরবান করেছিল , তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রমহল , আর দেশীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সকলেরই বিরাগভাজন ছিলেন তিনি। সেইসাথে ছিল নিজ দলের সুযোগসন্ধানীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড।
ফলে সূযোগ বুঝে চরম আঘাত হানে ঘাতকের দল। সেদিন থেকে শুরু হয় জাতির পেছন পথে চলার এক ইতিহাস। অক্ষ্ম আক্রোশে মুক্তিসেনার দল কবি বিপ্লব বড়ুয়ার মতোই অস্ফুত উচ্চারণে বলে ওঠেন,
“সেই পল্টনে বলেছিলে তুমি, তোদের অস্ত্র জমা চাই,
পঁচাত্তরেই হেরে গেছি তাই, হে জাতির পিতা, ক্ষমা চাই।”
বাঙালি বিতর্কপ্রিয় জাতি। বিতর্ক বাঙালির মজ্জাগত অভ্যাস। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের তাঁর দলীয় রাজনীতি বা শাসক হিসেবে সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়েছে অতীতে। হবে ভবিষ্যতেও। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের পেছনে এই মহামানবের অবদান অস্বীকার করা সম্ভব হবে না কারো কোনদিনই।
ঘাতকের দল মনে করেছিল শারীরিক ভাবে হত্যা করলেই হয়তো হারিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা শূন্যে মিলিয়ে দিয়েছে তাঁকে ভালোবাসা অগণিত মানুষ। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব পরিণত হয়েছেন আরো শক্তিধর কিংবদন্তীতে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ২১ বছর অক্লান্ত চেষ্টা করেও এতোটুকু চিড় ধরানো যায়নি বিশ্বাস আর ভালোবাসার সেই দূর্গগুলোতে। দলীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক সময়ে ক্ষোভের ঝড় উঠেছে, হয়েছে ভাঙা গড়ার খেলা। কিন্তু আজো দূর্ভেদ্যই রয়ে গেছে দূর্গগুলো।
দলীয় রাজনীতির ধারেকাছে না থেকেও এই দূর্গের নীরব সেনানীরা আজো তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছেন অপার্থিব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সংমিশ্রণে। তাঁর ছায়া অনুপ্রাণিত করে আজো বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শক্তিকে সেই একাত্তরের মতোই একই দীপ্ত তেজে। কবি অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায় বলতে গেলে ,
“যতদিন রবে পদ্মা , মেঘনা, গৌরী , যমুনা বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।”
শোকাবহ আগস্টে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, “ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূণ্য স্মৃতির প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ অভিবাদন ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)