অ্যালেন গিন্সবার্গ। মার্কিন কবি। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’—যেটির পরে ভাবানুবাদ ও সুরারোপ করে কণ্ঠ দেন ভারতের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। সেই গানের কল্যাণে যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটারের এই সড়কটি আমাদের কাছে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই সড়কের দুপাশে শতবর্ষী গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসে এবং গাছগুলো অক্ষত রেখেই রাস্তা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরও এখানে কিছু সংশয় ও প্রশ্ন থেকেই যায়। সে বিষয়ে আলোকপাতের জন্যই এই লেখা।
গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে আসেন কলকাতায়। তখন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো এই যশোর রোড। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গিন্সবার্গ যশোর সীমান্ত এবং এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা দেখেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন কবিতাটি।
এই মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। এরমধ্যে আছে ১৭৪ বছরের পুরাতন যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দারের লাগানো তিন শতাধিক রেইনট্রি; যা এ মহাসড়কে ছায়া দেয়ার পাশাপাশি সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু গত মার্চে রাস্তা সম্প্রসারণের নামে এই গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ফুঁসে ওঠে স্থানীয়রা। সংবাদ প্রচার হয় পত্রিকা ও টেলিভিশনে। ফলে সরকার এই গাছগুলো রেখেই রাস্তা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়।
বস্তুত সারা পৃথিবীতেই অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পরিবেশের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করে। মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর উষ্ণতা এবং যার ফলে বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ—তেমনি সড়ক যোগাযোগ, ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে গিয়ে কাটা পড়ছে অজস্র বৃক্ষ। ধ্বংস হচ্ছে ফসলি জমি, নদী, খাল, জলাশয়। শিল্প-কারখানার বর্জ্য আর কালো ধোঁয়ায় প্রবৃদ্ধির চাকা দ্রুতগামী হলেও ভেতরে ভেতরে আমরা বাসের অযোগ্য করে ফেলছি আমাদের প্রিয় এই ধরিত্রীকে। অর্থাৎ উন্নয়নের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন বলি গাছ বাঁচাও পরিবেশ বাঁচাও—তখন আমাদের এই প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয় যে, আমরা কি উন্নয়ন চাই না?
জলবায়ু পরিবর্তন বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত এবং পৃথিবীর মানুষ বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী গরিব দেশগুলো যখন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে এই পরিবর্তন টের পাচ্ছে—তখনও কিন্তু একটি বিশাল অংশ, যারা পৃথিবীর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে যেমন বৃহৎ তেল কোম্পানি, শিল্পোন্নত দেশ এবং কারখানা মালিকরা জলবায়ুর পরিবর্তন অস্বীকার করছেন। কারণ এই ভয়াবহ বাস্তবতা স্বীকার করে নিলে এর দায় তাদের নিতে হবে। এই পরিবর্তন স্বীকার করে নিলে কমাতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এই পরিবর্তন স্বীকার করলে কমাতে হবে ভোগের মাত্রা। কিন্তু তার জন্য প্রস্তুত নন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ব্যক্তিগণ। ফলে একদিকে ধরিত্রীকে বাঁচানোর আকুতি—অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ফলে চরম ঝুকিপূর্ণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে কি করবে না—সেই অহেতুক তর্কেও আমাদের সময় নষ্ট করতে হয়।
মানুষের প্রয়োজনেই প্রশস্ত হবে সড়ক। বাড়বে শিল্প-কারখানা। কমবে ফসলি জমি—এটি নির্মম বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতার বিপরীতে এখন এটিও প্রমাণিত যে, পরিবেশের বুকে করাত না চালিয়েও উন্নয়ন করা সম্ভব—যেখান থেকে এসেছে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ধারণা। সেই বাস্তবতায় যশোর রোডের দুপাশের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা নিশ্চয়ই সাধুবাদযোগ্য। ব্যস্ততম এবং গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক কি তাহলে প্রশস্ত হবে না?
এই সড়কের ভারত অংশে মাঝখানে গাছ রেখেই চার লেন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি সম্ভব। অর্থাৎ শতবর্ষী গাছগুলো তাদের জায়গায়ই সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকবে¬, কিন্তু তার দুপাশ দিয়ে নির্মাণ করা হবে নতুন সড়ক। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ অংশে সড়কের পাশে অধিগ্রহণযোগ্য জমির পরিমাণ কম। অনেক জায়গায় রাস্তালাগোয়া মানুষের বসতি। ফলে বৃক্ষশোভিত সড়কটিকে মাঝখানে রেখে দুপাশে নতুন রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে বহু মানুষকে সরাতে হবে। তখন সামনে আসবে তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের প্রশ্নটি। কিন্তু এই কাজ কঠিন হলেও নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়।
কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন, এই গাছগুলো নিশ্চয়ই অনন্তকাল বেঁচে থাকবে না। গাছগুলোর আয়ু কমে আসবে এবং একসময় সব গাছই মারা যাবে। কিন্তু এখন এগুলো কাটলে প্রচুর পয়সা পাওয়া যাবে, যা কাজে লাগবে সড়কের উন্নয়নে। এই বাস্তবতা সবাই বোঝেন। কিন্তু তারপরও মানুষ চায় না গাছগুলো কাটা পড়ুক। কারণ যতদিন সে জীবিত থাকবে, ততদিন সে এই ধরিত্রীর জন্য বিলাবে জীবনদায়ী অক্সিজেন, ছায়া দেবে মানুষকে; যার দাম ওই বৃক্ষ বিক্রি করে পাওয়া অর্থের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাছাড়া সারা পৃথিবীতেই এরকম শতবর্ষী গাছ সংরক্ষণ করা হয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই। এসব গাছ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। বিশেষ করে যশোর রোডের এই গাছগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
বিদেশে তো বটেই, আমাদের দেশেও প্রচুর বাড়িঘর আমরা দেখতে পাই যেগুলোর ভেতর দিয়ে উঠে গেছে বড় বড় গাছ। অর্থাৎ গাছ না কেটেই ঘরবাড়ি তৈরি সম্ভব হলে, নিশ্চয়ই রাস্তাও বড় করা সম্ভব। আর সেই গাছ যদি হয় এরকম কালের সাক্ষী, তাহলে সেই গাছের প্রতি মানুষের মায়া আরও অনেক বেশি। যে কারণে যখন এই গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী কবির সুমন। তিনি লেখেন, ‘শুনছি চার হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। একটি গাছও যদি কাটা হয় আমি প্রতিবাদ করবো। কী বড় বড় গাছ যশোর রোডের দুপাশে। কত বছর লেগেছে ঐ গাছগুলো অমন আকার পেতে। বনস্পতি। মহীরুহ। ওরা যে আমাদের বুক ভরে দেন অক্সিজেন। ওঁরা যে আমাদের গুরুজন- বন্যপ্রাণীদের মতো। ওরা যে আমাদের কী- স্নিগ্ধ ছায়া দেন। ওদের ঐ সবুজ রঙ! ওরা যে পৃথিবীর সব প্রাণীর সখা, সেবক, অভিভাবক, প্রেমিক।’
আমাদের গ্রামের বাড়ির রাস্তা সম্প্রসারণের করাতেও কাটা পড়েছিল একটি বিশাল জামরুল গাছ যার ডাল নুয়ে পড়েছিল পুকুরে। বড় হয়ে যখন কবির সুমনের ‘পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ, চিনত একটা ছটফটে মাছ’ গানটা শুনি, তখন মনে পড়ে আমাদের শৈশব-কৈশরের দুরন্তপনার সাক্ষী ওই জামরুল গাছটির কথা। আহা, কত ভরদুপুরে তার ডালে উঠে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছি! কিন্তু কথিত সেই উন্নয়ন, সেই রাস্তা সম্প্রসারণের করাতে যখন গাছটি কাটা পড়ে, তখন একজন প্রিয় মানুষের মৃত্যুর মতোই কষ্ট পেয়েছিলাম। বহু বছর পরে সেই কষ্ট যেন কিছুটা লাঘব হলো যশোর রোডের গাছগুলো বেঁচে যাওয়ার খবরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)