‘স্ত্রী মালা ও ছেলে মিলনকে নিয়েই বাকি জীবন একসাথে কাটাব’ বলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানালেন ১৯ বছর পর জামিনে কারামুক্ত হওয়া যাবজ্জীন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মো. ইসলাম মৃধা।
বৃহস্পতিবার স্ত্রী মালাকে নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে হাজির হয়ে এ কথা বলেন স্বামী ইসলাম।
এ সময় আদালত মালা ও ইসলামের কাছে জানতে চান এখন কোনো সমস্যা আছে কি না?
জবাবে মালা বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে ভাল আছি।’
ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রী ও ছেলে নিয়েই বাকি জীবন একসাথে কাটাব।’
ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ইসলামের যাবজ্জীবন সাজা মৌকুফের বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরেন।
আদালত বলেন, ‘যেহেতু নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে আপিল বিভাগ পর্যন্ত ইসলামের যাবজ্জীবন সাজা বহাল হয়েছে; তাই এখনই আমারা সাজা বাতিল করতে পারি না। এখানে আইনী বিষয় রয়েছে।’
‘‘তবে কোন যুক্তিতে ইসলামের সাজা বাতিল করা যেতে পারে সেটা আপনি (আইনজীবী) লিখিত আকারে আবেদন করলে, তখন সেটা আমারা ইসলাম ও মালার জীবনের বর্তমান বাস্তবতা প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করব।’’
এরপর সর্বোচ্চ আদালত ইসলামের জামিন চলমান রেখে আদেশ দেন। এসময় ইসলামের বাবা ও মালার বাবা আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলেন।
আদালতকে তারা দুজনই বলেন, আমারা দুই পরিবার একে অপরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক এখন ভালো। গত ঈদেও এক পরিবার আরেক পরিবারের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম।
এর আগে স্ত্রী মালা ও ছেলে মিলনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় গত ১ আগস্ট দেড় যুগ পর যাবজ্জীন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইসলামকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
গত ৯ আগস্ট ১৯ বছর ১৭ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান ইসলাম। আজ বৃহস্পতিবার ধার্য তারিখ অনুযায়ী আপিল বিভাগে আসে মালা ও ইসলাম। তবে চাকরির কারণে বাবা-মায়ের সাথে আজ আদালতে আসতে পারেনি ছেলে মিলন।
সিনেমার গল্পের মত মালা ও ইসলামের জীবনের ঘটনার সম্পর্কে থেকে জানা যায়, ঝিনাইদহের লক্ষীপুর গ্রামের মেয়ে মালার সাথে একই গ্রামের ইসলামের প্রেমের সম্পর্ক হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করতে থাকেন। এরপর স্থানীয় মৌলভীর মাধ্যমে ২০০০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী বিয়ে করেন।
২০০১ সালের ২১ জানুয়ারী মালার গর্ভে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। যার নাম রাখা হয় মিলন। তখন মালার পরিবার ও স্থানীয়রা সামাজিকভাবে বিয়ে করার কথা বললে, ইসলাম মালার সাথে তার বিয়ে ও মিলনের পিতৃত্ব অস্বীকার করেন।
এরপর মালার পিতা ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন। পরবর্তীতে এ মামলায় বিচারিক আদালত ইসলামকে যাবজ্জীন কারাদণ্ড দেন। সাজার এই রায়ের বিরুদ্ধে ইসলাম আপিল করলে হাইকোর্টে সাজার রায় বহাল রাখেন।
পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ইসলাম আবেদন করলে আপিল বিভাগও সাজার রায় বহাল রাখেন। এরপর আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইসলাম।
এই রিভিউ শুনানিতে যাবজ্জীন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইসলামের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে মালা ও মিলনের স্বীকৃতির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আপিল বিভাগকে বলেন, মালা ইসলামেরই স্ত্রী। আর মিলন যে ইসলামের সন্তান সেটা হাইকোর্টের আদেশের পর ডিএনএ রিপোর্টেও প্রমাণিত। এরই মধ্যে কারাগারে ইসলাম ও মালার বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে। তাই মালা ও মিলনকে ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানের স্বীকৃতি দিয়ে ইসলামকে কারামুক্তি দেওয়া হোক।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ আগস্ট আপিল বেঞ্চ যাবজ্জীন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইসলামকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেন।
ফি ছাড়াই মামলা লড়েছেন আইনজীবী
বিনা ফিতে আপিল বিভাগে রিভিউ মামলা লড়া আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মালা ও মিলনকে স্বীকৃতির পরই আপিল বিভাগ ইসলামকে জামিন দিয়েছেন। ইসলাম কারামুক্ত হয়েছেন। সে তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাকি জীবন কাটানের কথা আদালতকে বলেছেন।
‘‘তিনজন বিচ্ছিন্ন মানুষকে এক করে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারার আনন্দ একজন আইনজীবী হিসেবে আমার জীবনে অনন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর আদালত মানেই যে সজা আর বিচার নয়, আদালত মানেই যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো তা এই রিভিউ এর ফলাফলের মাধ্যমেই নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’’