চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মাবিয়ার কান্নায় সুবিধাবাদী আমাদের জন্য যে লজ্জা

আনন্দ-বেদনা কিংবা আবেগ প্রকাশের সেরা মাধ্যম কি কান্না! নাকি কান্না তারচেয়েও বেশী কিছু! আমরা দেখলাম চোখের দু’ ফোঁটা অশ্রুর কি অপরিসীম শক্তি। কয়েকশো মাইল দূরের গুয়াহাটির ভোজেশ্বরি পুকানানি ইনডোর স্টেডিয়ামের বিজয় মঞ্চে মাবিয়া আক্তার সীমান্তর কান্না ১৬ কোটি মানুষকে জোর এক ধাক্কা দিয়ে গেলো।

আমরা যারা খেলার মাঠে নানা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে তাদের গালে কষে এক থাপ্পর কি দিলো না অষ্টাদশী মাবিয়ার কান্না? এ শুধু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দু’ফোঁটা অশ্রু নয়, এ আমাদের মতো তেলে মাথায় তেল দেয়ায় অভ্যস্ত সুবিধাবাদী মানুষদের লজ্জা দেয়ার মোক্ষম হাতিয়ারও।

গত অক্টোবরে যুব কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণ জিতেছিলেন মাবিয়া। মিডিয়ায় সেই সাফল্যের নূন্যতম প্রচার ছিলো না। এসএ গেমসে যাওয়ার আগে তার স্বর্ণ জেতার প্রত্যয়ের কথা বিশ্বাস হয়নি, বরং তার প্রত্যাশা আমাদের মতো গতানুগতিকতার স্রোতে গা ভাসানো নির্বোধ কারো কারো কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিলো।

আমাদের অজ্ঞতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পর হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্য এবার শুরু হবে আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা। বাংলাদেশ আনসারের ছোটখাটো চাকুরে এই সাধারণ ঘরের তথাকথিত অতি সাধারণ মেয়েটিকে নিয়ে মিডিয়ায় তুলবো প্রবল মাতামাতি। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি, বিওএ’র এক নম্বর এমনকি সস্তা প্রচারের জন্য বিদগ্ধ কেউ কেউ অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেবেন মাবিয়া-মাহফুজাদের। ঘোষণা হবে অর্থ পুরস্কার। সোনার পদক নিয়ে ফেরার দিন এই সোনার মেয়েদের ক্যামেরার সামনে গলায় মালা পরিয়ে দিতে বিমানবন্দরে হুড়োহুড়ি লেগে যাবে কর্মকর্তা-সাংবাদিকদের। এরপর হয়তো দু’একটি সংবর্ধনা, গালভরা প্রতিশ্রুতি, টিভি রিপোর্টারের বুমকে সাক্ষী রেখে হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা বলে প্রতিশ্রুতির বন্যা।

সাধারণ পরিবারের এইসব অসাধারণ ছেলেমেয়েরা সেই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে নতুন করে শুরু করবে অনুশীলন, জীবন সংগ্রাম। সময়ের স্রোতে আমরা ভুলে যাবো মাবিয়া-মাহফুজাদের যেমনটা ভুলেছিলাম শ্যুটার আসিফ, সাবরিনা, ওয়েট লিফটার হামিদুল কিংবা এসএ গেমসের সাবেক দ্রুততম মানব অকালপ্রয়াত মাহবুবকে। ভোগবাদি সমাজে সংবাদকে ভোগ্যপণ্য বানানো আমরা নিত্যনতুন খুঁজে ফিরি চটকদার সংবাদ। যে ক্রীড়াবিদের গ্ল্যামার নেই তাদের নিয়ে রিপোর্ট বানিয়ে লাভ কি!

মনে পড়ছে সপ্তাহ দুয়েক আগে কভার করা একটি অনুষ্ঠানের কথা। ২০১৪’র এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জপদক জয়ী বাংলাদেশের মহিলা কাবাডি দলকে দেয়া হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকার অর্থ-পুরস্কার। জাতীয় খেলা কাবাডিতে এশিয়ার তৃতীয় সেরার স্বীকৃতি এনে একেকজন খেলোয়াড়ের প্রাপ্তি মাত্র ৪১ হাজার টাকা। তাও প্রতিশ্রুতি দেয়ার দু’বছর পর আরেকটি গেমসের আগে! তারপরও বিওএ’র দেয়া সামান্য অর্থ কি পরম আগ্রহভরে তুলে নিলো মেয়েরা। না, তাদের চোখে শুধু অর্থ লাভের সন্তুষ্টিই ছিলো না, ছিলো দেশকে পদক এনে দেয়ার গর্ব। কি অল্পতেই তুষ্ট আমাদের এই বীরেরা।

অথচ এই দেশের ক্রীড়াঙ্গনেই উড়ছে বেশুমার টাকা। দেশের হয়ে খেলে কিছু পাচ্ছি না এমন ঘ্যানঘ্যান করে কান ঝালাপালা করিয়ে দেয়া উচ্ছৃঙ্খল একেকজন তারকা ফুটবলারের পেছনে বছরে ষাট-সত্তর লাখ টাকা ঢালতে একপায়ে খাড়া ক্লাব কর্তরা। দুর্বল জিম্বাবুয়ে কিংবা কমজোরি নিউজিল্যান্ডকে দেশের মাটিতে, ফরমায়েশী উইকেটে ‘বাংলা-ওয়াশ’ করার পর ক্রিকেট দলকে কি দেয়া হয়নি গাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার কোটি টাকা? বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে একবেলা খেয়েই উড়িয়ে দেন হাজার পঞ্চাশ, এমন খবর আমরা কি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করিনি!!!

দোহাই ভাববেন না বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের বিলাসী জীবনযাপনে ঈর্ষান্বিত আমরা। সারা পৃথিবী মাতানো দেশের সেরা সন্তানরা সচ্ছল জীবনযাপন করবে এটাইতো স্বাভাবিক। বরং তাদের উন্নত জীবনযাপন ক্রিকেটে উৎসাহিত করবে পরবর্তী প্রজন্মকে যেখানে থাকতে পারে আমার আপনার সন্তান। তবে মাঝে মাঝে মাবিয়া-মাহফুজারা সোনার পদক জিতে আমাদের ফেলে দেয় কঠিন লজ্জায়, অনুশোচনায়। যেখানে প্রকাশ হয়ে পড়ে কিভাবে কর্পোরেট আগ্রাসন আর বাণিজ্যের ছ্যাবলামিতে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে উপেক্ষিত হয় প্রাদপ্রদীপের আলো বঞ্চিত সেইসব খেলা আর তার আন্তর্জাতিক সাফল্য পাওয়া খেলোয়াড়রা।

মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা অভাব-অনটনে থেকেও দিনের পর দিন ঘাম ঝরানো অনুশীলন করেন। সার্ভিসেস’র একটি চাকরি কিংবা অনুশীলনের সুবিধাই তাদের কাছে অনেককিছু। বেশীরভাগ সময় সেটাও জোটে না। তারপরও কমনওয়েলথ, এশিয়াড কিংবা এসএ গেমসে সোনা-রূপার পদক জিতে আমাদের চমকে দেন তারা। কিছু না পেয়েও দেশকে কিছু দেয়ার পর তাদের নিষ্পাপ কান্না আমাদের অপরাধী করে। এই অপরাধের দায় একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে এড়াই কি করে!

ক্রীড়া সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কঠিন এক জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়েছিলাম একবার। পেশাগত ঘনিষ্ঠতা থেকে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হওয়া ছোট ক্রীড়া ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা একবার গল্পের ছলে নির্মম বাস্তবের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

তার কথাটা ছিলো এরকম: ‘মিডিয়া ফুটবল, মিডিয়া ক্রিকেট আয়োজনের জন্য বড় বড় কর্পোরেট হাউস আপনাদের সংগঠনকে পাঁচ/দশ লাখ টাকা এক নিমিষে দিয়ে দেয়। এইসব টুর্নামেন্টের জন্য আপনারা দামী জার্সি, হকির অ্যাস্ট্রোটার্ফ যথেচ্ছ ব্যবহার করেন, নিজেদের ইভেন্ট বলে মিডিয়ায় দেন বেশুমার কাভারেজ। পাশাপাশি আমাদের মতো ছোটখাটো ফেডারেশনগুলোকে যদি একটু কাভারেজ দিতেন, তাহলে স্পন্সররা আমাদের দিকেও হাত বাড়াতো। হয়তো পাল্টে যেতো অনেককিছু।’

পাল্টাবো কি আমরা?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)