চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভোলায় কী হলো, কেন হলো…

যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের একটা বড় অংশই যে এটার ব্যবহার জানেন না এবং জেনে বুঝেই এটার অপব্যবহার করেন, তা নিয়মিত বিরতিতে নানা ঘটনায় প্রমাণিত হয়। চোখ খোলা রাখলে দেখা যাবে, এদের মধ্যে কথিত শিক্ষিত লোকজনও রয়েছেন। অর্থাৎ কালচারড বা সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য শিক্ষাই যে একমাত্র শর্ত নয়, তা ফেসবুকে অনেক শিক্ষিত লোকের স্ট্যাটাস, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়। কিন্তু আখেরে এর ভিকটিম হয় সাধারণ মানুষ। যার সবশেষ উদাহরণ ভোলার বোরহানউদ্দিন। সেখানে কী হয়েছিল এবং কেন হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি কারা এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে—সেটির নিরপেক্ষ অনুসন্ধান।

সোমবার দুপুরের পরে একটি ব্যক্তিগত কাজে পুরানা পল্টনে গিয়ে বিশাল এক মিছিলের জন্য রাস্তায় আটকে যাই। একটি ইসলামিক দলের আয়োজনে ওই বিক্ষোভ মিছিল হয়। সাম্প্রতিককালে রাজধানীতে এত বড় মিছিল হয়েছে কি না জানি না। পুলিশের অনুমতি নিয়ে এই মিছিল হয়েছে কি না বা তারা আদৌ পুলিশের অনুমতি চেয়েছে কি না সেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালো বলতে পারবে। কিন্তু ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারী অনেকের মুখ থেকে যেসব ভাষা ও শব্দ শুনেছি এবং ভোলার ঘটনায় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া বা তাদের মুখের অভিব্যক্তি খেয়াল করেছি, তাতে মনে হয় তাদের মনে এই ধারণা ও বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বোরহানউদ্দিনে পুলিশ ইচ্ছা করেই ‘তৌহিদ জনতা’কে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে এবং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মহানবীর অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের শত্রু। সামান্য একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে, সেটি অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেই লিখুন অথবা তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেই লেখা হোক না কেন, এর প্রতিক্রিয়ায় প্রথমে ভোলার বোরহানউদ্দিন এবং এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে যা হচ্ছে বা হয়েছে, সেটি কতটা স্বতস্ফূর্ত আর কতটা স্বার্থসংশ্লিষ্ট, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। তার আগে বোঝা দরকার আসলেই কী হয়েছিল এবং কেন হয়েছিল?

এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়, সেখানে বলা হয়েছে, গত ১৮ অক্টোবর নিজ ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য (২৫) ওরফে শুভ নামে এক যুবক রাত ৮টা ৫ মিনিটে ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানায় জিডি করেন। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেদিন রাতের মধ্যেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য’র ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে কলকারী শরীফ এবং ইমন নামে দুই মুসলিম যুবককে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে বোরহান উদ্দিন থানায় নেওয়া হয়। কিন্তু শুভ’র ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া কথিত ‘কমেন্টের’ জেরে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা উত্তেজিত হতে থাকেন। রবিবার সকাল ১১ টায় বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরের ঈদগাহ মাঠে তারা প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দিলে জেলা প্রশাসক, ইউএনও, থানার অফিসার ইনচার্জ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আলেম সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শনিবার সন্ধ্যায় বোরহান উদ্দিন থানায় দীর্ঘ সময় বিষয়টি আলোচনা হয়। আলেম সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য’কে আটক দেখানো হয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আলেম সমাজ তাদের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচি বাতিলের ঘোষণা দেন।

ভোলা-দাবি মেনে নিলো প্রশাসন
ফাইল ছবি

তা সত্ত্বেও রোববার সকাল থেকেই কিছু লোক ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে বসানোর জন্য ১৭টি মাইক নিয়ে আসা হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সমবেত লোকজনকে সরিয়ে নিতে বললে উপস্থিত আলেমরা নিশ্চিত করেন, লোকজন কোনও রকম বিশৃঙ্খলা করবেন না। কিন্তু একদল লোক বিনা উস্কানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণকারীদের গুলিতে ও হামলায় বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিসহ পুলিশের তিনজন সদস্য মারাত্মক আহত হন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রথমে টিয়ার শেল ও পরে শটগান চালায়। পরিস্থিতি আরও খাবার হলে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়।

ধারণা করা অমূলক নয় যে, এই ঘটনার পেছনে কিছু অতি উৎসাহী লোকের অতি উৎসাহই মূলত কাজ করেছে। যেমন কেউ যদি সত্যিই মহানবীকে কটূক্তি করে ফেসবুকে কিছু লিখে থাকেন, তাহলে এটি তার অতি উৎসাহ। কারণ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অধিকার কারো নেই। তাছাড়া এ জাতীয় কথাবার্তার কারণে এর আগেও দেশে বহু সহিংসতা হয়েছে। প্রাণহানি হয়েছে। সুতরাং ফেসবুকের মতো ওপেন প্লাটফর্মে মানুষ কী লিখবে তার চেয়ে বেশি জরুরি কী লেখা উচিত নয়, সেটি।

দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে একজন হিন্দু নাগরিকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মহানবী সম্পর্কে অবমাননাকর কথা লেখা হয়েছে। যদি আসলেই এটা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই হ্যাককারীও একজন অতি উৎসাহী এবং তার এই অতি উৎসাহের পেছনে অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। কারণ প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী লোক ছাড়া একজন সাধারণ মানুষ অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করতে পারেন না। তার মানে যিনি আইডি হ্যাক করেছেন তিনি প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী এবং বড় কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এটা করেছেন। তার উদ্দেশ্য যদি থাকে এই যে, তিনি মহানবীর অবমাননার মতো একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করবেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এর পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে।

প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী কিন্তু বড় কোনো উদ্দেশ্য নেই—এমন কেউও হয়তো ব্যক্তিগত শত্রুতার বশে ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করতে পারেন। কিন্তু আসলেই এক্ষেত্রে কী হয়েছিল সেটা খতিয়ে দেখা দরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই কাজটি করছে।

প্রশাসনের সাথে বৈঠকে সিদ্ধান্তের পরেও কারা স্থানীয়দের সংগঠিত করলো এবং কেন তারা একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো? পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কিছু লোক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। তাহলে আগ্নেয়াস্ত্রধারী এই লোকগুলো কারা? আগ্নেয়াস্ত্র দূরে থাক, সাধারণ মানুষের হাতে একটা চাপাতি থাকারও কথা নয়। তাহলে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের ভিড়ে এই ‘অসাধারণ’ মানুষগুলো কারা?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে দাবি করছে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে, এ কথাও নির্বিবাদে মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ অতীতে অনেক ঘটনায় পুলিশের অতি উৎসাহের উদাহরণ আছে। সুতরাং সত্যি সত্যিই সেখানে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, সেটিরও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।

২.

ধরা যাক কেউ একজন মহানবীকে নিয়ে ফেসবুকে কিছু একটা লিখলেন। এটা হতে পারে তার জ্ঞানের অভাব অথবা দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণে তাকে মেরে ফেলতে হবে, এ কথা ইসলামের কোথায় আছে? মহানবীর জীবিতকালে তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলার লোক ছিল না? তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে এমন লোক ছিল না? তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো এমন মানুষ ছিল না? মহানবী চাইলে এদের সবাইকে চূড়ান্ত শাস্তি দিতে পারতেন না? কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছাড়া মহানবী কারো গায়ে সামান্য একটা আঁচড় দিয়েছেন, এরকম উদাহরণ কোনো ইসলামিক পণ্ডিত বলতে পারবেন? মহানবী যে মাত্রার সহনশীল মানুষ ছিলেন, তাঁর আগে পরে আর কোনো মানুষ এতটা সহনশীল, দয়ালু ও পরোপকারী কি ছিলেন? সুতরাং মহানবী সম্পর্কে কে কী বললেন বা লিখলেন তাতে তাঁর কী আসে যায়? তাতে ইসলাম ধর্মেরই বা কী আসে যায়? বরং কেউ যদি ফেসবুকে মহানবী সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা লেখে, তার ফেসবুকেই এর জবাব দেয়া যায়। তাকে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়। কিন্তু তারপরেও যদি কেউ বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তার জন্য আইনি প্রতিকার আছে। এসবে না গিয়ে হাজার হাজার লোককে রাস্তায় নামিয়ে ইসলাম ও মহানবীর ভাবমূর্তি রক্ষায় যে কথিত জিহাদের ডাক দেয়া হলো, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কী? এমনকি প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার পরও কাদের উসকানিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামলো?

যারা রাস্তায় নামলেন তাদের কতজন ফেসবুক ব্যবহার করেন এবং ফেসবুক সম্পর্কে জানেন? চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, ‘তৌহিদী জনতা’র নামে যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, তাদের অধিকাংশই ফেসবুক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না বা ফেসবুকে কিছু একটা লিখলে যে তাতে কিছু যায় আসে না, সেটিও তাদের মাথায় থাকে না। আবার কোনো বিশিষ্ট লোকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেন তাদের নিয়তে হয়তো কোনো গড়মিল থাকে না। তারা হয়তো মনেই করেন, নিজের ধর্মের পক্ষে দাঁড়ানো বা পরকালে শান্তি লাভের জন্য এই প্রতিবাদটুকু তার করাই উচিত। কিন্তু নিজে অনুসন্ধান করেন না, আসলে কী ঘটেছিল বা সেটি কতটা গুরুতর?

একই কথা আমাদের জাতীয় নেতাদের সম্পর্কেও। তাদের অনেককে নিয়েও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হয়। কার্টুন হয়। কিন্তু দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে দ্রুত আটক করে। মামলা হয়। ফলে এখানেও সহনশীলতা বাড়ানো দরকার। কোথায় বসে কে কী লিখলো তাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত অথবা উচিত নয়, সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

সর্বোপরী যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন তাদেরও এই মাধ্যমটি সম্পর্কে জানা দরকার। মনে যা এলো লিখে দিলাম, কাউকে চোর বা রাজাকার বলে গালি দিলাম—এটাও কোনো সভ্য লোকের আচরণ হতে পরে না। অর্থাৎ সমস্যাটা এখানে সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকের না। সমস্যাটা ব্যক্তির কালচার ও মূল্যবোধের। বলাই হয়, একজন লোকের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মন্তব্য দেখেই তার সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। কারণ তিনি যা বিশ্বাস করেন, যা ভাবেন এবং তিনি আসলে কেমন, সেটিই প্রতিফলিত হয় তার ফেসবুক ওয়ালে। সুতরাং মানুষ যত সভ্য ও ভদ্র হবে, তার মধ্যে সহনশীলতা যত বাড়বে, সে যত বেশি গণতান্ত্রিক ও উদার হতে শিখবে, ততই ফেসবুককেন্দ্রিক অপপ্রচার কমতে থাকবে। কিছু লোক সমাজে সব সময়ই থাকবে যারা অন্যকে হেয় করে মজা পাবে। কিছু লোক সমাজে থাকবেই যারা সব সময়ই কোনো একটি ঘটনা থেকে ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ফায়দা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তাদের সবাইকে চিহ্নিত করাও সহজ নয়। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। তাই বলে কেউ কিছু একটা লিখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, বড় ধরনের সহিংসতা উসকে দিতে হবে, এটিও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)