আগে দল গঠন, রাজপথের লড়াই সংগ্রাম পরে ক্ষমতায় আরোহন বিএনপির বেলায় এমনটি ঘটেনি। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে যুগের পর যুগ ধরে রাজপথের লড়াই সংগ্রাম করে আসছে কিন্তু অদ্যাবধি ক্ষমতায় যেতে পারেনি।পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রাজপথে সক্রিয় ছিল বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ।এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তারা রাজপথে ছিল। এ সময় আরও ছিল জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় থাকে তারা। কিন্তু এসব আন্দোলন এসব দলকে কি কোন সুফল দিলো? দলীয় পরিচিতিতে এদের কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার মত গণভিতই সৃষ্টি করতে পারলোনা আজও।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলো, দল গঠন করলো। আর সে দলে যোগ দিতে দেখা গেল হতাশ বিপর্যস্ত এসব রাজপথের নেতাদের। অনেক বামনেতা ও ডান নেতাকে দেখা গেল জিয়ার বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী এমপি হয়ে যেতে। এদেশে আন্দোলন সংগ্রাম করে যে ক্ষমতায় যাওয়া যায়না, বিএনপি কি এমন ভুলটি বুঝেই তবে চুপসে গেল? অতীত কী বলে? আওয়ামী লীগের ইতিহাস লড়াই সংগ্রামের। লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই দলটি গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার সক্রিয় ভূমিকা।
বিএনপি এখন কোন পথে যাচ্ছে? কোথায় গেল তাদের এত এত কর্মীবাহিনী? সরকার বিরোধী আন্দোলন নিশ্চয়ই কোন সরকারই করতে দিতে চাইবেনা। তারা যখন ক্ষমতায় ছিলো তারাও কি চাইতো তখন? তারা কি রাজপথে আওয়ামী লীগের এমপিদের লাঠিপেটা করেনি? আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমদ, ১৪ দল নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ,জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর উপর লাঠিচার্জ করেনি?
যে কোন সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেই করতে হয়। আর যদি সেটা এরশাদ জমানার গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকার মত না হয়। বিএনপি আসলে কোনটা হতে চাচ্ছে? যথার্থ বিরোধী দল না গৃহপালিত বিরোধী দল? বিএনপি সাংগঠনিক ভাবে চরম অযোগ্যতা ও দেউলিয়াত্বে চলে গেছে। আন্দোলন করবে কি। দলটির কবে সম্মেলন হয়েছিল তাওতো ভুলে গেছে মানুষ। দেশব্যাপী জেলা উপজেলায় আহবায়ক কমিটি গঠন করে রেখেছে। পূর্নাঙ্গ কমিটি করতে সম্মেলনের নূন্যতম প্রস্তুতি নেই তাদের। আসলে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গঠিত না হয়ে ক্ষমতার মাধ্যমে গঠিত হলে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে।
বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়ে। সম্মেলন করে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গড়ার যোগ্যতাও তাদের নেই।তারা বলে আন্দোলন করতে দিচ্ছেনা সরকার। এক্ষেত্রে কি তারা বলবেন সম্মেলনটিও করতে দিচ্ছেনা সরকার। এমন খোঁড়া অজুহাত দিয়ে আর কতদিন? দ্লটি এখন নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে পর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। কিছুদিন চেষ্টা করেছে জামাতকে দিয়ে রাজপথে উঠতে। এতে ব্যর্থ হয়ে পরে চেষ্টা করেছে হেফাজতকে দিয়ে। কোনটাই সফল হলোনা। এরপর চেষ্টা বিদেশী লবিং। এখন কথা উঠছে বিদেশী গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে অর্থ প্রদান। এ কথাও সত্য হতে পারে। একটি দল পথ ও নিজের প্রতি আস্থা হারালে যা হয়। হয়তো বিএনপির বেলা তা ই হচ্ছে। সরকার আন্দোলন করতে কখন সহায়তা করবে। যখন ক্ষমতায় থাকবে বিএনপি। তাই নয় কি?
তবে বিএনপির যে অতীত আন্দোলনের ইতিহাস একেবারেই নেই তা নয়। জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এলো এরশাদ। তখন কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দ্লীয় জোটটি রাজপথে সোচ্চার ছিল। তখন হয়তো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল ও বাম নেতৃত্বাধীন ৫ দল ছিল বলেই সেটাও নিশ্চয়ই ছিল নির্ভরতা কেন্দ্রিক আন্দোলন। ৮ দল, ৫ দল আন্দোলনে না থাকলে তখনও হয়তো রাজপথমুখী হতে পারতোনা তারা।
এরশাদ পতনের পর বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এলো। তখন দলটির ছিল খুবই রমরমা অবস্থা। ক্ষমতা চলে গেল ১৯৯৬ সালে। ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। তখনও দলটি রাজপথে সরব ছিল। সাথে ছিল জামাত। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এলো দলটি। দেশ জুড়ে বেড়ে গেল জঙ্গীবাদের আস্তানা। শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই, ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, রমনার বটমূলে হামলা, সিপিবির সমাবেশে হামলা, আদালতে বিচারক হত্যা, আত্মঘাতী জঙ্গী কতকিছু ঘটলো সেসময়ে। বিএনপি দলটি হয়ে উঠল জঙ্গী নির্ভর। এক কথায় দলটির গায়ে নির্ভরতা শব্দটি যেনো একেবারে খোদাই করা। এটি বুঝি আর খসে পড়ার কোন লক্ষনই নেই।
ক্ষমতায় থাকলে নির্ভরতা এক ধরনের ক্ষমতায় না থাকলে আরেক ধরনের। দলটি আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতা হারিয়ে এমনই দেউলিয়া হয়ে উঠছে যে নিজেদের বিরোধী দলের ভাবমূর্তিও রক্ষা করতে পারলোনা। তারা এ জাতীয় সংসদকে অবৈধ বলছে আবার জাতীয় সংসদে কয়েকজন যাচ্ছেও। সৈয়দা আশরাফী পাপিয়ার স্বামী হারুন অর রশীদ এমপি হলেন। এ বিষয়ে পাপিয়ার বক্তব্য তারা তাদের এলাকায় ভোট কারচুপি প্রতিহত করেছেন। এ কথা সত্য হলেতো এটা পরিস্কার যে যোগ্যতা থাকলেই ভোট কারচুপি প্রতিহত করা যায়। বিএনপি কেন দেশব্যাপী এমন যোগ্যতা হারালো?
অজুহাতের খোঁড়া যুক্তি ক্ষতিটা কিন্তু অন্যের নয় নিজেরই করে। বিএনপিও লাগাতার তা ই করে চলছে। তারা হারিয়েছে নিজেদের সাংগঠনিক শৃংখলা, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা। হারিয়েছে কেন্দ্র হতে জেলা উপজেলা পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের যোগ্যতা।ক্ষমতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত দলটি ক্ষমতার কাছেই হেরে গেলো। পথহারা পথিকের মত হয়ে গেল সে। এখন কথা উঠছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগের বিষয়। এ কথা সত্যি হলেও তাও হবে পথহারা পথিকেরই আচরণ। এসব বিনিয়োগ দেশের আন্দোলনের জন্য করলে তা যথার্থ হতো। যে দেশে টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে সভা সমাবেশ ও মানব বন্ধন করা যায় সেদেশে বিএনপি কিছুই পারছেনা ঘরে বসে ব্রিফিং ছাড়া। এ লজ্জাটা নিশ্চয়ই তাদের নিজেদেরই। কোথায় গেল হরতাল, অবরোধ ও সভা সমাবেশের মুখর বিরোধী রাজনীতি? এর দায় কেবল সরকারের নয় অবশ্যই বিরোধী দলেরও রয়েছে।রয়েছে তাদের যোগ্যতা, সাহসিকতা ও দৃঢ়তার অভাব। দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ মানব বন্ধনের কর্মসূচী দিলে পুলিশ কয়জনকে গুলি করবে? দেশব্যাপী অনশনের ডাক দিলে সরকার কয়জনকে গুলি করবে?
আর এত ভয় পেলে কি আন্দোলন হয়? ভীতুরা কে কোথায় আন্দোলন করেছে? আসলে বিএনপির এমন কোন সাহসই নেই।নেই কোন নেতৃত্বের যোগ্যতা। যে দল মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ার পরও সম্মেলন করে নিজ দলের নেতৃত্বই নির্বাচন করতে পারেনা সে দল গণ আন্দোলন করবে সরকার পতনের লড়াই করবে এমন মনে করাটা খুবই অর্বাচিনই বটে। অথচ এই দলটিই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরস্কার হিসাবে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় গেছে। ১৯৯৬ সাল হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিরোধী দল হিসাবে সংসদে ও রাজপথে সক্রিয় থেকে ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় গেছে। তখন দলটির চেয়ারপার্সন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হওয়ার পর থেকেই চুপসে যেতে থাকে দলটি। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতির অভিযোগে যাকে দেশত্যাগ করতে হয়। যার আর দেশে আসারই কোন সুযোগ নেই। এমন একজন বিতর্কিত ও দন্ডিত ফেরারী ব্যক্তিকে প্রধান নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়া কি দলটির অদূরদর্শিতা নয়? অনেক দলীয় নেতাও এই নেতৃত্ব নির্বাচনের সমালোচনা করে চলছেন। দলটি আগামী দিনে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে কোন কোন আন্দোলনের ফসল হিসাবে? ১৯৯১ ও ২০০১ এর বিএনপি আর আজকের বিএনপির মধ্যে কি আকাশ পাতাল তফাৎ নয়?
বিএনপি হয়ে উঠছে না সরকার দল না বিরোধী দল। না পারছে সরকারের জনমুখী ইতিবাচক কর্মকান্ডের প্রশংসা করে জনতার কাছে যেতে। না পারছে সরকারের গণবিরোধী নেতিবাচক কর্মকান্ডের সমালোচনা করে জনতার কাছে যেতে।দলটির ভবিষ্যৎ কর্মপ্রক্রিয়া কি তাও বুঝা যাচ্ছেনা। আগামী দিন ক্ষমতায় যাবে কোন আন্দোলনের পরিণতিতে? রাজপথেতো তাদের কোন ভূমিকাই নেই। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বিএনপি রাজপথে ছিল। দেশব্যাপী সভা সমাবেশ ও মিছিল মিটিংয়ে ছিল। সংসদেও ছিল। এবারতো কোথাও নেই। বিরোধী দলের মর্যাদাটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। বিরোধী দল হয়ে গেছে জাতীয় পার্টি। দলটি হয়ে উঠছে পরনির্ভর, নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল। প্রতি মহানগরে সমাবেশ করবে এই ঘোষনাটিও দল দিতে পারলোনা। দিলো মহানগরের মেয়র প্রার্থীরা। এতে দলটির অথর্ব কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিক ও তার দেউলিয়াপনা আরও পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠলো। সম্প্রতি তারা বেশ নির্ভরশীল হয়ে উঠছে আল জাজিরার প্রতিবেদনটির উপর। এক কথায় নিজ নির্ভরতা হারিয়ে বিএনপি সমুদ্রে নির্ভরতার খড়কুটো খুঁজে বেড়ানোর মত পরনির্ভরতা খুঁজে চলছে। আর এই খোঁজায় বিএনপির কী লাভ হবে সরকারের কী ক্ষতি হবে, দেশ ও জনগণের কী লাভ হবে তাও তারাই ভাল বুঝেন। সময়ের আয়নায় কী দেখা যায় তা সময়ই বলে দেবে।