বাংলাদেশ-ভারত সেমিফাইনাল খেলার আগে বদনকিতাবে পোস্ট দিয়েছিলাম, ভারতের সাথে হবে বন্ধুত্বের প্রতিযোগিতা আর পাকিস্তানের সাথে হবে শত্রুতার। দুই প্রতিযোগিতাতেই আমরা জিতব ইনশাল্লাহ’। খেলার রেজাল্ট এখন সকলেই জানেন, ‘বন্ধু’ ভারতের কাছে হেরে বাংলাদেশ বিদায় নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে। খেলায় হারজিত থাকেই। কিন্তু আমার পোস্টে মন্তব্যকারীদের প্রায় সবাই আমাকে বললেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের শত্রু দেশ, কিন্তু ভারতও আমাদের আর বন্ধু নাই।
মন্তব্যকারীদের মধ্যে বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন, আছেন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। গ্রামের বন্ধুরাও বাদ যাননি মন্তব্য করা থেকে। গ্রামের ব্যবসায়ী বন্ধু এমন এক মন্তব্য করলেন তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তিনি বললেন, ‘শত্রু পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বন্ধু ভারতের কাছে পরাধীন হলাম’।
খেলার পর আগরতলার এক নারী পুলিশ অফিসার বদনকিতাবে লিখলেন- ‘সান্তনা বাঘের বাচ্চাদের জন্য, ভারত মায়ের সন্তান’। আমার ভালো লাগল না, আমি কমেন্ট করলাম-‘বাংলাদেশ ভারত মায়ের সন্তান না, বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু’। পোস্টকারী কিছু বললেন না। অনেকে তাকে সতর্ক করলেন, বাংলাদেশকে ‘ভারত মায়ের সন্তান’বলা তার ঠিক হয়নি, এতে করে বাংলাদেশের ‘বন্ধুরা’চরম অপমানিত বোধ করতে পারেন। দীর্ঘক্ষণ পরে কলকাতাবাসী একজন এসে আমার মন্তব্যের রিপ্লাই দিলেন খুব বাজে ভাষায়। তিনি বাংলাদেশকে ‘কাংলাদেশ’(!) উল্লেখ করে বললেন, ‘সরি, ভারত কাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে না!’
এমন মন্তব্য দেখার পর কোন বাংলাদেশীর মেজাজ ভালো থাকবে বলুন! আমার জন্মভূমির নাম এভাবে কেউ বিকৃত করতে পারে আমি কল্পনাও করিনি। এরপরও আমি ভারতকে নিয়ে বাজে কিছু বলা থেকে বিরত থাকলাম। আমি পাল্টা জবাব দিলাম, ‘তুমি বাঙালি হওয়ার যোগ্য না। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের যে চেতনা, তুমি তার বিরোধী’। এরপরও তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য অব্যাহত রাখলে আমি বললাম, ‘বাংলাদেশ কাঙ্গালদের দেশ না, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী দরিদ্র লোকের বসবাস ভারতে। বাংলাদেশ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স সোর্স।’ এর জবাবে তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া লোকজনের রেফারেন্স দিয়ে বললেন, ‘তোমরা যে কাঙাল, সেটা তোমার দেশের মানুষই আমাদের কাছে এসে বলে।’ আমি এখন অসহায় বোধ করলাম। আমার নিজের দেশের মানুষই বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম করে! এরপরও বললাম, ‘আমাদের লোকজন তোমার দেশে যায় বলেই তোমাদের ইনকাম হয়, তোমরা বেঁচে থাকার অবলম্বন পাও’। কলকাতাবাসী সেই যুবকের সাথে তর্কাতর্কি এখনো চলছে। সময় নষ্ট হচ্ছে আমার, কিন্তু কী করা! চোখের সামনে নিজ মাতৃভূমির অপমান কারো সহ্য করা উচিত না।
খেলা শুরুর আগে অরণিভাস গুপ্ত নামে কলকাতার এক দাদা পোস্ট দিয়ে লিখলেন, ‘আশা করি বাংলাদেশ-ভারত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, কিন্তু ভারত জিতবে’। একজন ভারতীয় বাঙালি হিসেবে খুব যৌক্তিক পোস্ট। বাংলাদেশের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ পেল, আবার তিনি নিজ দেশের বিজয়ও আশা করলেন। উনার পোস্টে একজন মন্তব্য করলেন, বাংলাদেশীদের পিটিয়ে ছাতু বানানো উচিত। অরণিভাস দাদা এতে ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশে ১৫ কোটি লোক বাংলায় কথা বলেন, আপনি তাদেরকে মারতে বলেন’? আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভারতের সবাই যেমন বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে না, আবার বাংলাদেশেরও সবাই ভারতকে শত্রু মনে করে না। তবে বাংলাদেশে যারা ভারতকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাদের কথা ভিন্ন। একদল আছে ভারতের নামই শুনতে পারে না, আরেকদল ভারত বলতেই অজ্ঞান। এই দুইদলই বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। বাস্তবতায় বসবাস করে যারা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বন্ধুত্বের আবহে রাখতে চায়, তারাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশী কাঙ্ক্ষিত।
২০১৩ সালে বউ নিয়ে নিজের টাকায় ভারত গেলাম। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি। সরকারি সেসব সফরে জনগণের টাকায় বড় বড় হোটেলে থাকার, বিশ্বের বড় বড় নেতাদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য নিশ্চয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে, শেখ হাসিনার মিডিয়া টিমে কাজ করার সুযোগ পাওয়া। সাংবাদিকতা ছেড়ে শিক্ষকতার নতুন পেশায় এসে বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলাম ভারত। মানুষ হানিমুনে যায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা সুইজারল্যান্ড। আমি গেলাম আগরতলা। ভারতে আগরতলা হল আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, আমি বলি আমার ঘাঁটি। আগরতলায় বেশ ভালোবাসা পেয়েছি। বিশেষ করে আমার গ্রাম কালীকচ্ছের বড় ভাই, বর্তমানে ত্রিপুরার ডেপুটি স্পিকার বাবু পবিত্র কর আমাকে পিতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন। গ্রামের বড় ভাই, কাকুদের সাথে দেখা হয়েছে। আবেগে কেঁদে ফেলেছি। আগরতলা থেকে ভুপেন হাজারিকার গৌহাটি গেলাম। সেখানে ত্রিপুরা ভবনে একরাত থেকে গেলাম স্বর্গসম শিলং এ। সর্বদা, সর্বময় একটা ভালো লাগার অনুভূতি।
কলকাতায় গিয়ে হল অন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের একসময়ের রাজধানী। কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই শহরের সাথে। কলকাতায় গ্রামের আরেক বড় ভাই সন্তোষ সেন নিতে এলেন এয়ারপোর্টে। বললেন, ‘তোরা কেন হোটেলে উঠবি? আমার বাড়িতে থাকবি’। আমি ভাবলাম, এত করে বলছে, থেকে যাই। সন্তোষ দা আমাদের গ্রামের। পেশায় চিকিৎসক এই ভাইজান বিয়ে করেছেন পশ্চিমবঙ্গীয় এক নারীকে। সন্তোষ দা যেভাবে কথা বলেন, উনার স্ত্রী, শাশুড়ি এবং সন্তানেরা এভাবে বলেন না। এয়ারপোর্টে নামতে নামতেই বিকেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। সন্তোষ দার বাড়ি নিউ সল্টলেকে। নতুন আবাসিক এলাকা। রাতে খেয়ে সন্তোষ দার স্ত্রী, শাশুড়ির সঙ্গে কথা বললাম। উনাদের আগ্রহ খুব কম। অন্যদিকে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। আমরা সন্তোষ দার স্ত্রীকে, শাশুড়িকে বললাম আমাদের গ্রাম কালীকচ্ছে বেড়াতে আসতে। বললাম, বিমানে ৪০/৫০ মিনিটে ঢাকায় চলে আসবেন। আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি দিয়ে আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে গ্রামে পৌঁছে যাব। উনাদের আগ্রহ দেখলাম না খুব একটা। রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি, আশেপাশে অনেক দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। কোনোটার কাজ শেষ, কোনোটার চলছে। এমন জায়গা আমার মোটেও পছন্দ না। ফোন করলাম বাবু পবিত্র করকে। বললাম, দাদা এখানে আমার ভালো লাগে না, আপনি সন্তোষ দাকে বলেন যে, আমরা চলে যাব। দাদা ফোন করে সন্তোষদাকে বলে দিলেন। আর আমাকে বললেন, ত্রিপুরা ভবনে যাও, আমি বলে দিচ্ছি। আমরা ত্রিপুরা ভবনে চলে গেলাম। সন্তোষ দা পরের দিন এলেন ত্রিপুরা ভবনে। আমি বললাম, আজ যাব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কফি হাউস ইত্যাদি দেখতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেট্রো দিয়ে যাব নাকি ট্যাক্সি? দাদা বললেন, মেট্রো দিয়ে যাবেন। জীবনে বহুবার এমন পাতাল রেলে উঠেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপান, চীন, সাউথ কোরিয়াসহ সব উন্নত দেশেই এমন পাতাল রেলের ব্যবস্থা আছে। জাপানে তো একবার বুলেট ট্রেনে উঠলাম। ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা পার হলাম মাত্র ৪ ঘণ্টায়। সবগুলো দেশের ছবি আছে আমার। মাটির নিচে, ট্রেনের ভেতরে, বাইরে, ভেতরে বসা অবস্থায়, দণ্ডায়মান, নানা কায়দায় ছবি তোলা আছে।
নতুন বউ নিয়ে এসেছি বিদেশ সফরে, তাও আবার আমাদেরই একসময়ের রাজধানী কলকাতায়। তাই ক্যামেরা বের করলাম। তখনো ট্রেন আসেনি। ক্যামেরা বের করতেই দৌড়ে এল এক লোক। প্রথমেই একটানে ক্যামেরা নিয়ে নিলেন। ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে গেলেন তার অফিসে। খুব কর্কশ ভাষায় কথা বলছিলেন তিনি। লজ্জায় পড়ে গেলাম। যাওয়ার আগে বউকে কত কথা বলেছি! নচিকেতার গান শুনিয়েছি! ইতিহাসের গল্প শুনিয়েছি। শুধু বলেছিলাম, এমন করে কথা বলছেন কেন? যে উত্তর দিলেন সেই কলকাতাবাসী, তাতে আতংক ভর করল মনে। একা থাকলে আমি জেলে জেতেও প্রস্তুত ছিলাম। সাথে আমার বউ, জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সেই লোক আমাকে বললেন, ‘জঙ্গি বানিয়ে পুলিশে দিয়ে দেবেন।’ সাথে থাকা সন্তোষ সেনও কিছু বলতে পারলেন না। হয়ত বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে যাওয়া বলে আত্মবিশ্বাস কম, অথচ কম করে হলেও ৩০ বছর ধরে কলকাতায় বসবাস করছেন ইনারা। আমার বউ, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। আমাদেরকে নাকি ক্যামেরা বের করার অপরাধে জঙ্গি বানিয়ে পুলিশে দেবে! খুব মন খারাপ করে ‘সরি’বলে কোনমতে বের হয়ে আসতে পারলাম।
কলকাতায় পাতাল রেলে যে ছবি তোলা যায় না, সেটা আমি জানতাম না। হয়ত নতুন নতুন আসছে বলে, কলকাতায় মেট্রো রেল নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে। বিশ্বের ২০/২৫টা উন্নত শহরে আমি গিয়েছি। ওসব শহরে ছবি তোলা যায়। পরের দিন দেখা করতে এলেন প্রশান্ত দাদা । আমাদের বর্দ্ধন বাড়ির ছেলে। আমার বড় ভাই, মুরুব্বি। দাদা এসে এত ভালোবাসা দিলেন তাতে রেলকর্মকর্তার সেই জঙ্গি আচরণের কষ্ট ভুলে গেলাম। প্রশান্ত দাদা এমনিতে খুব ব্যস্ত মানুষ। মুম্বাই থাকেন, চলচ্চিত্র নির্মাতা। আমার কপালগুণে সে সময় কলকাতায় ছিলেন। দাদার আচরণ দেখে আগরতলার কথা মনে পড়ল। কম সময়ের মধ্যে কলকাতার অনেক কিছু খাওয়ালেন, ইডেন গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া পার্ক ইত্যাদি ঘুরে দেখালেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক মনে হয় আমার সেই ভারত সফরের মতই, অম্ল-মধুর। কেউ ভালোবেসেছে, কেউ জঙ্গি বানিয়ে পুলিশে দেবার হুমকি দিয়েছে। ভারত কি আমাদের শতভাগ বন্ধু? শতভাগ শত্রু? দুটোর উত্তরই ‘না’। জগতে কেউ কারো শতভাগ, নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ বন্ধু হতে পারে না। আমি এবং অনেকেই মনে করি যে, ভারত ও বাংলাদেশ বন্ধু রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মানুষ আবার সেটা মনে করেন না। মনে করলে আমাকে জঙ্গি বানিয়ে পুলিশে দেয়ার হুমকি দিতেন না কলকাতার সেই রেল কর্মকর্তা। ক্রিকেট খেলা নিয়ে, সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তা নিয়ে দুই দেশের হাজার হাজার মানুষ বাজে সব তর্কে জড়াতেন না।
দিনকয়েক আগে নানা বিষয়ে ভারতের ‘দাদাগিরি’নিয়ে একটা পোস্ট দেয়াতে এক দাদা খুব ক্ষেপে বললেন, ‘দোষ সব ইন্দিরা গান্ধীর, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে যত ঝামেলা বাঁধিয়েছেন! ’জগমোহন ডালমিয়াকেও তিনি একটু ঝাড়লেন, বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার মর্যাদা ‘পাইয়ে’দিয়েছেন বলে! এই কথা পড়ে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ভারতের অনেকেই, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে মনে করে ভারত আমাদেরকে স্বাধীনতা ‘ভিক্ষে’হিসেবে দিয়েছে! তাই আমাদের নদীর পানি, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ন্যায্য কথা বলতে গেলে ওনারা ৭১ সালের কথা নিয়ে আসেন। আমাদের দেশেও একটি শ্রেণি আছে যারা ভারতের কাছে বাংলাদেশের নানা অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান ইস্যু নিয়ে আসেন।
ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছে, তাদের হাজারেরও বেশি সৈন্য এখানে প্রাণ দিয়েছেন। আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন। তাই বলে ১৯৭১ এর কৃতজ্ঞতার জন্য সারাজীবন দাস হয়ে থাকতে আমরা পারব না। কৃতজ্ঞতা আর দাসত্ব এক জিনিস না। ভারত আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে । অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়েছে, এগুলো সব ঠিক। কিন্তু আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, আমাদের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, লাখ লাখ মা-বোনের উপর চালানো নির্যাতন, ধ্বংস হওয়া লাখ লাখ ঘরবাড়ি, শত শত সেতু, হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা রাস্তাঘাটসহ বিশাল ক্ষয়ক্ষতির দাম নেই? পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই যেসব পূর্বপুরুষ বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনে কাজ শুরু করেছিলেন তাদের মূল্য নেই? বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বের স্বীকৃতি দেবেন না? তাজউদ্দীন আহমেদ এর সাংগঠনিক অবদানের মূল্য দেবেন না? আমরা যদি বলি, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি ভারতকেও পাকিস্তানের একটা অংশ থেকে নিরাপদ রেখেছে বাংলাদেশের বীর জনতা, তখন কি ভুল বলা হবে? দুইপাশে আজ যদি পাকিস্তান থাকত তাহলে, ভারতের কী অবস্থা হত? এক কাশ্মীর সামাল দিতেই ভারত নাকানিচুবানি খাচ্ছে।
বাংলাদেশ যতটুকু পারছে ভারতকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে বাংলাদেশ। ‘সাত বোনের’সংসার শান্ত রাখতে বাংলাদেশ দারুণ কাজ করে দিচ্ছে ভারতের হয়ে। দুষ্ট প্রতিবেশি ছোট হলেও বড় প্রতিবেশীর ঘুম হারাম হতে পারে, এ কথা ভারতকে বুঝতে হবে। ভারতের হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে কাজ করে জীবিকা অর্জন করেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশ হল ভারতের তৃতীয় বড় রেমিট্যান্স সোর্স। বাংলাদেশের ট্রানজিট হতে পারে ভারতের ‘সাত বোনের’ উন্নয়নের সঠিক চাবিকাঠি।
বাংলাদেশের একটা অংশের মানুষের মনে প্রশ্ন হল, এভাবে একতরফা ভাবে নানা সুবিধা দিয়ে গেলে কি তাকে বন্ধুত্ব বলা যায়? আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয়েকমাস আগে ভারত গেলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে বিমানবন্দরে এসে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়ার্তুমির জন্য নাকি তিস্তার পানি দিতে পারেননি। অথচ ভারতের সংবিধানে লেখা আছে, বিদেশের সাথে কোন চুক্তি করতে হলে রাজ্য সরকারের সম্মতি নেয়া ফরজ না।
আমাদের সন্দেহ, সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারও চায় না বাংলাদেশ তিস্তার ন্যায্য পানি প্রাপ্ত হোক। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে মানুষের ভেতরে হিন্দুত্ববাদের শক্তিতে প্রবেশ করাতে চায় বিজেপি, তাই ঘাটাতে চায় না মমতা ও তার দলকে। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যাও একটা বড় ইস্যু। এত মানুষ পাকিস্তানের সীমান্তেও নিহত হয় না ভারতের হাতে। বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে শুল্ক ও নানা কৌশলগত বাধা, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি, বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ভারতে প্রদর্শিত হতে না দেয়ার কৌশল সব মিলে ভারত বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে । ছিটমহল বিনিময় করতে দীর্ঘ সময় পার করেছে ভারত ।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় ছিটমহল বিনিময় হল এই সেদিন। চুক্তি সম্পাদনে ভারতের গড়িমসিই যে এই বিলম্বের কারণ সেটি বলাবাহুল্য। এ সমস্ত ক্ষোভকে আমলে নিচ্ছে কি ভারত?
আরেকটা বিষয়, ভারতীয়দের একাংশ বাংলাদেশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এমন একটা আচরণ করে যেন, ভারত একটা উন্নত রাষ্ট্র, আর আমরা বুঝি অনেক গরীব। শুধু পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটা রাষ্ট্র উন্নত হয় না। এমন অস্ত্র তো পাকিস্তানেরও আছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনক্লুসিভ ইকোনমিক গ্রোথ ইনডেক্স এ বাংলাদেশ ভারত থেকে ২৪ ধাপ এগিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টার এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ভারতের স্থান পুরো বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের নামই নেই সে তালিকায়। ব্যাংক রিজার্ভে বাংলাদেশ সাউথ এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে আছে। আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এখন অনেক আধুনিক। সম্প্রতি ভারতের অন্যতম ‘শত্রু’রাষ্ট্র চীন থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয়ের পরে ভারতের আচরণ দেখেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ আগের তুলনায় এখন অনেক শক্তিশালী। বিশ্বে মাত্র দুটি দেশ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি বাংলাদেশ। ভারতের জন্ম হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। আমাদের গর্ব করার অনেক কিছু আছে।
এতকিছুর পরও বর্তমান বাস্তবতা এবং ইতিহাসের বিচারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধু হিসেবে বেছে নিতে বললে আমরা নির্দ্বিধায় ভারতকে বেছে নিতে চাই। পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি থাকার বা রাখার অবকাশ নেই, প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু ভারত যেন আমাদের প্রতিটি দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে ন্যায্য আচরণ করে। ১৯৭১ এ পাশে ছিলেন, তাহলে পরে কেন থাকবেন না? আমরা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে সবসময় বলতে পারি, ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)