একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আকাশ-পাতাল ব্যবধানে হেরে গেছে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে যে দল ২০৭ টি, ১৯৯১ সালে ১৪০টি, ১৯৯৬ সালে ১১৬টি, ২০০১ সালে ১৯৩টি আসনে জয়ী হয়েছে—বিশাল জনসমর্থনপুষ্ট সেই দল ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩০টি আসন এবং সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৫টি আসনে জয়ী হয়েছে—এটি যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, রুলস অব গেম অনুযায়ী এটিই এখন বাস্তবতা।
এই বাস্তবতা বিএনপি মেনে নেবে না, তারা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাদের দলের বিজয়ী ৫ প্রার্থী শপথ নেবেন না, এটিও বাস্তবতা। কিন্তু এ দুই বাস্তবতার মাঝখানে এ বিষয়েও একটু নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন যে, বিএনপির মতো একটি দল ২০০৮ সালে কেন মাত্র ৩০টি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ৫টি আসন পেলো। কেন তাদের দলের বাঘা বাঘা অনেক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার উপক্রম হলো? এখানে কি শুধুই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলই এককভাবে দায়ী নাকি বিএনপির ভুল রণকৌশলও এই বাস্তবতা তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে?
মনে রাখা দরকার, এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনের কৌশল ছিল খুব পরিস্কার যে, বিএনপিকে মাঠে দাঁড়াতে দেবে না। যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে এবং গত এক দশক ধরে প্রশাসনসহ সর্বস্তরে আওয়ামী লীগের একটা শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে তার এই নির্বাচন কৌশল বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন সহায়তা করবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই কৌশল ভেদ করে বিএনপি ও তার দুটি জোট এমন কোনো পাল্টা কৌশল নিতে পারেনি যাতে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত হয়।
বিএনপির এবারের নির্বাচনী কৌশল অনেকটা খেলার আগেই হার স্বীকারের মতো। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেই নির্বাচনি কৌশল নিয়ে যে বিভক্তি, তা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বরকতউল্লাহ বুলুর একটি ফোনালাপে স্পষ্ট—যেখানে মওদুদ পরিষ্কার বলছেন যে, তারা চেয়েছিলেন ৩০০ আসনের বিএনপি ও জোটের প্রার্থীরা ঢাকায় এসে অবস্থান নেবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রচার করলে সারা বিশ্বেই বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। ওই টেলিফোন আলাপে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের প্রতি মওদুদের তীব্র ক্ষোভও স্পষ্ট। ভোটের দুদিন আগে বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিও ভোট বর্জনের আহ্বান জানান। তার মানে হলো, বিএনপি তাদের ভোটের কৌশলই ঠিক করতে পারেনি অথবা তাদের মধ্যে তীব্র সমন্বয়হীনতা আছে। আওয়ামী লীগের মতো একটা দলের সাথে এরকম বড় ভুল তো দূরে থাকে, যে কোনো সিলি মিসটেকও (সামান্য ভুল) পরাজয়ের কারণ হবার জন্য যথেষ্ট।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিজের কারণেই হেরেছিল এবং মাত্র ৩০টি আসনে জিতেছিল। কারণ ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা যেভাবে বিচার বিভাগে রদবদল এবং নিজেদের লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল, সেই কৌশল মেনে নেয়নি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং স্বভাবতই তারা এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মাঠের সেই আন্দোলনে বস্তুত আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। আর ভোটের আগে আন্দোলনের মাঠ যার দখলে থাকে, ভোটের ফলাফল তার অনুকূলেই যায়, এ কথা অতীতেও প্রমাণিত। ওই বছর বিএনপি যদি নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হবার পরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো এবং সেই সরকারের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতো, তাহলে আর যাই হোক ৩০টি আসনের লজ্জা পেতে হত না। কারণ বিএনপি যে নবম সংসদ নির্বাচনে জিতবে না তা পরিস্কার ছিল। কারণ আগের ৫ বছরে তারা যেসব কাজ করেছে, তাতে স্বভাবতই জনমত তাদের বিরুদ্ধেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে না চেয়ে তারা যেসব খেলা খেলেছে, তাতে রাজনীতিটা আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। মনে রাখা দরকার, রাজনীতি যখন রাজনীতিবিদদের হাতের বাইরে চলে যায়, তখন সেখানে এমন সব শক্তি ঢুকে পড়ে, যারা পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জিততে আওয়ামী লীগ তার মতো ছক আঁকলেও বিএনপি সেই ছকে পা না দিয়ে ভোট বর্জন করে। এতে তারা কতটা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তারা ওই সময়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সেখানে পেট্রোলবোমার সহিংসতা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, জনমত তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। পক্ষান্তরে সরকারও সেই আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আন্দোলনের মাঠে বিএনপি বস্তুত ব্যর্থ হয়। আর আন্দোলনে ব্যর্থ হলে ভোটে জয় হবে না, সেটিই রুলস অব গেম।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সামনে রেখেও বিএনপি ওই অর্থে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অহিংস হওয়ায় দেশের মানুষ খুশি হলেও আখেরে তারা তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে তাদের প্রধান দাবি নির্দলীয় সরকাররে অধীনে নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়। কেননা এরজন্য প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন। ১৯৯৬ সালের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের সংসদ গঠন করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করতে বাধ্য করেছিল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ১৯৯৬ সালে তারা যেমন আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হয়েছে, দুই দশক পরে এসে সেই বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কাছে ফের পরাজিত হয়। দেখা যাচ্ছে বিএনপির জনসমর্থন ও ভোট যতই থাকুক, তারা বারবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতি, কৌশল ও শক্তিমত্তার কাছে হেরে যায়। হেরে গিয়ে ভোটেও পরাজিত হয় এবং সেই পরাজয়ের ব্যবধানটি ক্রমশ বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হলো বিএনপির মতো একটি দল মাত্র ৫টি আসনে জয়ী হওয়ায় ভবিষ্যতে তাদের রাজনীতির ধরন ও কেশৗল কী হবে? বিএনপির নেতৃত্বে কি আদৌ পরিবর্তন আসবে? দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দলের চেয়ারপারসনের কারাবন্দি থাকা এবং দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতারও বিদেশে পালিয়ে থাকার কারণে এককভাবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি সংগঠিত হতে পারেনি। কারণ দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা, একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান লন্ডনে থাকলেও দলের যাবতীয় নীতি-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত এখনও যে তার নির্দেশেই হয়, সে কথা সবার জানা। ফলে ভবিষ্যতে বিএনপির রাজনীতি এভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির স্টাইলে চলতে থাকলে সেটি তাকে আরও বেশি খাদের কিনারে নিয়ে যাবে।
অনেকেই এটি মনে করেন যে, এবারও যদি ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী বা জেএসডির আ স র রবকে সাথে না নিয়ে এককভাবে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করত এবং নির্বাচনে অংশ নিতো, যদি বিতর্কিত জামায়াতের ইসলামির ২২ জনকে প্রার্থী না দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত ত্যাগের ঘোষণা দিতে পারতো, তাহলে বিএনপি অন্তত ৫টি আসন পেত না। তারেক ও জামায়াত ইস্যু না থাকলে সরকারও হয়তো এত হার্ডলাইনে থাকত না। যদিও কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, তারেক রহমানের প্রতি মানুষের ওই অর্থে কোনো সহানুভূতি না থাকলেও ব্যক্তি খালেদা জিয়ার প্রতি অসংখ্য মানুষের সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতি রয়েছে।
ফলে জিয়া পরিবারকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে এককভাবে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে দল কতটুকু এগোতে পারবে, সেই আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু তারপরও সাবেক আওয়ামী লীগারদের নিয়ে বিএনপি যে বেশি দূর যেতে পারবে না, সেই শিক্ষাটা নিশ্চয়ই তাদের হয়েছে। কারণ বিএনপির মনে রাখা দরকার, এই সাবেক আওয়ামী লীগাররা আওয়ামী লীগে জায়গা পেলে বা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে ভুলেও বিএনপিকে উদ্ধারের দায়িত্ব নিতে যেতেন না। অর্থাৎ তারা চেহারা বদলেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যেসব কথাবার্তা তারা বলেছেন, সেগুলো যে রাজনৈতিক বুলি, তা এখন বিএনপি নিশ্চয়ই টের পাবে। বিএনপির মধ্যে এখন যদি কেউ এরকম সন্দেহ পোষণও করেন যে, তাহলে ড. কামালরা ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের হয়েই কাজ করেছেন কি না, তাও অমূলক হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)