বছর পঁয়ত্রিশের রাইয়ান (ছদ্মনাম)। ঢাকার আজিমপুর এলাকায় থাকেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে। আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, ঈদের ছুটিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার যাবেন।
এই পরিকল্পনার মাঝে তার সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তা ছিল দীর্ঘ ভিড় ঠেলে, গভীর রাতে লাইনে দাঁড়িয়ে বাস বা ট্রেনের টিকিট কাটার বিষয়টা। কোনো বিড়াম্বনায় পড়তে চাননি তিনি। কিন্তু কীভাবে পাবেন টিকিট? এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় ফেসবুকের ঝকঝকে একটি পেজে।
সেই পেজে আকর্ষণীয় সুন্দর একটি বাসের ছবি দিয়ে লেখা: ‘এখন আর কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার দিন শেষ। ঘরে বসেই পাচ্ছেন স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানির বাসের টিকিট।’
যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান রাইয়ান। সাথে সাথেই যোগাযোগ করে কেটে ফেলেন পুরো পরিবারের ভ্রমণ টিকিট। বিকাশের মাধ্যমেই পরিশোধ করেন ভাড়ার পুরো টাকা। এরপর আসে কক্সবাজার যাত্রার সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। কিন্তু বাস কাউন্টারে যেয়ে যেন মাথায় বাজ পড়ে। তার নামে কোনো টিকিটই বরাদ্দ নেই! অনলাইনে যে টিকিট দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই ভুয়া।
রাইয়ানের বুঝতে বাকি থাকে না, অনলাইনে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছেন তিনি। সেবার আর কক্সবাজার যাওয়া হয়নি পরিবারটির।
এমন অসংখ্য মানুষ অনলাইনে ভুয়া টিকিট বিক্রির চক্রের শিকার হয়েছেন। এই ধরনের প্রতারণার শিকার হতে হয়েছেন বহু মানুষকে। তারা শুধু অর্থই হারাননি, মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। মুখোমুখি হতে হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিরও।
সেই চক্রকে দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছিল পুলিশ। অবশেষে ওই প্রতারক চক্রের মূল হোতাকে ধরতে করতে সক্ষম হয়েছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ। আটক করেছে নোকরুজ্জামানকে (২৫)। তার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। সে গত কয়েক বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণা করে আসছিলো। হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা।
তবে এতটা সহজে তাকে হাতে পায়নি পুলিশ। কেননা চতুর ও কৌশলী নোকরুজ্জামানকে কোনেভাবেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। এ যেন ‘বারবার ধান খেয়ে যাওয়া ঘুঘু’। তবে কয়েক মাসের চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত রোববার বিকালে রাজধানীর ডেমরা থানার সারুলিয়া নামক স্থান থেকে তাকে আটক করে পুলিশ।
জানা গেছে, অনলাইনে নানারকম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলো এ চক্রটি। এনা, হানিফ ও শ্যামলী পরিবহনের নামে ফেসবুকে ভুয়া পেজ খুলে সেখানে অনলাইনে টিকিট কাটার কথা বলে প্রতারণায় করে যাচ্ছিল। কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষ খুব সহজেই আকৃষ্ট হতো তাদের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে। কেটে ফেলতেন ভুয়া টিকিটও। কিন্তু বিপত্তি বাধতো যাত্রার দিন। কাউন্টারে গিয়ে যখন জানতে পারতেন, তাদের জন্য কোনো টিকিটই নেই। এ নিয়ে বাস কোম্পানিগুলোর সাথে যাত্রীদের বাকবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেতো মাঝে মাঝে।
এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে তেজগাঁও জোনের এসি সালমান হাসান চ্যানেল আই অনলাইন-কে বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতারক চক্রকে ধরতে আমরা কাজ করে আসছিলাম কয়েকমাস ধরে। তবে তার ব্যক্তিগত নম্বর থেকে টাকার লেনদেন না করায় তাকে আটক করা যাচ্ছিল না। এমনকি সে রাজধানীতে কখনো মগবাজার, কখনো তেজগাঁও, কখনো বা আবার মোহাম্মদপুরে অবস্থান করতো। কিছুদিন আগে রাত দুটোয় সে তার ব্যক্তিগত নম্বর থেকে একটি বিকাশ নম্বরে টাকা রিচার্জ করে। তার ভিত্তিতেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা তাকে আটক করতে সক্ষম হই।
তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নোকরুজ্জামান তার প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে। সে বেশ কয়েক বছর ধরেই বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অনলাইনে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলো।