বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গডফাদার মুফতি হান্নান। নানা অপকর্ম দিয়ে একটু একটু করে নিজেকে ভয়ঙ্কর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে সে।
আট হত্যা মামলার আসামি এই মুফতি হান্নান। এমনকি জড়িত ছিলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গেও।
মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়৷ আদালতে তার জবানবন্দী থেকে জানা যায়, তার পড়াশোনা গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে সে চলে যায় ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়।
দেওবন্দে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ওই দেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করে মুফতি হান্নান। পরের বছর ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে যায় এবং করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে ভর্তি হয়৷
শুরুটা আফগানিস্তান থেকে
সেখান থেকে তিনি সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে মুজাহিদ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে গিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয় হান্নান।
সেই যুদ্ধে আহত হয়ে পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেয় মুফতি হান্নান। এরপর করাচির ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করে।
দেশে ফিরে হুজি-বি
পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরে মুফতি হান্নান এবং ফিরেই পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন।
এর কিছু দিন আগে আফগানফেরত এদেশীয় মুজাহিদরা গঠন করে হুজি-বি সংগঠন। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে কার্যক্রম শুরু করে হুজি। সেসময় থেকে আফগানফেরত মুজাহিদরা মিলে হুজির নামে সংগঠনের ব্যানারে তৎপরতা শুরু করে। ১৯৯৪ সালের দিকে মুফতি হান্নান হুজি-বিতে যোগ দেয়। প্রথমে কোটালীপাড়া উপজেলার থানা প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পায় সে। সাংগঠনিক দক্ষতা থাকায় হুজি-বির নেতৃত্বে আসতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি।
অল্প দিনেই হুজি-বির শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসে হান্নান। হুজিতে থাকার পাশাপাশি মুফতি হান্নান হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়েও কার্যক্রম চালাতো।
জঙ্গি সংগঠন শক্তিশালীকরণ
এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশে সংগঠনটিকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা শুরু করে হান্নান। সমন্বয় সাধন করে জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে হান্নান বলে, দেশে অনৈসলামিক কাজ বন্ধ করার জন্য মৌখিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড সুপার মার্কেট হতে ভেতরের দিকে একটি রোডে আমাদের অফিসে ৪-৫ জন মিলে একটি আলোচনা সভা হয়। সেখানে মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির, বাগেরহাটের মাওলানা আবু মুসা, হাফেজ জাহাঙ্গীর বদর, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা আবু বকরসহ আরও ২-১ জন উপস্থিত ছিলো। সভার সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশে উদীচীর উলঙ্গ গান-বাজনা বন্ধ করা হবে। সেদিনই মাগরিবের পর মুগদা অফিসে আমীর মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, সাইদুর রহমানকে পেয়ে সেখানে উদীচীর গান-বাজনা বন্ধের বিষয়ে আলোচনা করি।
জবানবন্দীতে হান্নান আরও বলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। এরপর দেশের প্রখ্যাত আলেমরা ইসলামী আইনানুযায়ী দেশে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে দেশের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে ফতোয়া দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেন। তাতে আওয়ামী লীগ সরকার বাধা দেয়। তারা ফতোয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট মামলা করলে আদালত ফতোয়া দেয়া অবৈধ ঘোষণা করেন যাতে আলেম-ওলামাদের ফতোয়া দেয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবেই সংগঠনের নেতা কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে করে বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা করতো মুফতি হান্নান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনাও করে সে। সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেই সিদ্ধান্ত হয় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার।
একের পর এক জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এদেশে গোপন জঙ্গি সংগঠন হুজি-বির নাশকতা শুরু হয়। হুজি-বির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে মুফতি হান্নান ও মুফতি আবদুর রউফের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ হামলা হয় বলে হান্নানের জবানবন্দিতে উল্লেখ আছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও দেড়শ জন আহত হন।
এরপর একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়। তাতে নিহত হন আটজন।
২০০০ সালের জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে আলোচনায় আসে মুফতি হান্নান ও তার দল। এরপর থেকে আত্মগোপনে থেকে তৎপরতা চালাতে থাকে মুফতি হান্নান।
২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা।
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বির জঙ্গিরা।
এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় মুফতি হান্নানের দল। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি।
মুফতি হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে। এক সমাবেশে চালানো ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন।
২০০৫ সালে হুজি-বি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।