মুজিব নামটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা সাথে কালো ওয়েস্ট কোর্ট, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। যার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় চকচকে ঝকঝকে শানিত একজোড়া চোখ। অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত একজন অসাধারণ মানুষের ছবি। সেই মানুষের ছবি জেগে ওঠে যার হৃদয় ছিল আকাশের মত বিশাল, যার সকাল হত দেশের মানুষের কথা মনে নিয়ে, যে চোখে ঘুম নামতো দেশের আপামর মানুষের প্রতি ভালবাসা নিয়ে।
সেই মানুষটা আমাদের বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমান, আপামর জনতার ভালবাসা তাকে শুধু জাতির পিতাই করেনি করেছে বন্ধু বাংলার বন্ধু, বাংলার মানুষের বন্ধু, তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু। যার প্রেরণায় বিনা অস্ত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সমুখ সমরে নেমে ছিল বাঙলার আমজনতা। সাথে ছিল শুধু একবুক সাহস, আর এই সাহস জুগিয়েছিলেন আমাদের বাঙ্গালার বন্ধু আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তার ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে না।
যার চিন্তা চেতনায় সবার আগে এসেছে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, পেট ভরে ভাত খেতে পাবে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজে বাস করবে, দেশের মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হবে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একটা দেশ উপহার দিতে চেয়েছে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছিলেন তিনি, একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেকে উনি সাড়ে তিন বছরে সোজা করে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্ত সে হাসি হাসতে পারেন নি। কারণ ৭১’এ দোসররা রয়ে গিয়েছে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, সরকারে। আর তারাই নির্দ্বিধায় খুন করে দেশের একমাত্র বন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুকে।
সুখের বিষয় আমাদের বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ প্রধানমন্ত্রী, টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, তিনি গত বছর জানুয়ারী মাসে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুজিব বর্ষের, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিব বর্ষ’ পালন করবে সরকার। এই পুরো বছর দেশব্যাপী উৎসব করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালে জাঁকজমকভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হবে। এতে রজতজয়ন্তীর মতো বিশ্ব নেতাদেরও আমন্ত্রণ করা হবে।
গত বছর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় এ ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে পালন করবে জাতি। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম মাস মার্চ থেকে শুরু হবে এ উৎসব যা ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত চলবে। কী কী কর্মসূচি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে তা নিয়ে দলের বৈঠকে আলোচনা করা হবে বলে তিনি জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতেও আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। তখন বিশ্বের মানবতাবাদী তিন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এবারও সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের মানবতাবাদী নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সে হিসেবে ২০২১ সালে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে জাতি।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, বেশ একটা কর্মযজ্ঞ চলছে। কয়েকদিন পেপার পত্রিকা, অনলাইনে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটে দেখা গেল চলছে মুজিব বর্ষ পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ ও আলোচনা সভা। বিরাট অঙ্কের একটা বাজেট থাকবে মুজিব বর্ষ পূর্তিতে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ দেখবেন শুধুমাত্র, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, পোস্টার, লিফলেট ছাপিয়ে তোরণ বানিয়ে, বিরিয়ানি খাইয়ে টাকার অপচয় না হয়। শুধু মুজিব-বর্ষ পরিকল্পনার সভা করতে করতেই অর্ধেক বাজেট শেষ না হয়ে যায়।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত যে, বঙ্গবন্ধু যা করতে চেয়েছিলেন, যেভাবে চেয়ে ছিলেন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, সেইসব পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করলে তাকে সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হবে। তার জীবন ও কর্মের থেকে ছিটেফোঁটা শিক্ষা নিলেও দেশের মানুষের জীবন উন্নত হতে পারে। উনাকে চর্মচোখে না দেখলেও, পরিবারের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, ইতিহাস পাঠে যতটুকু জেনেছি বা তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচা পড়ে যতটুকু জেনেছি, তা আমার যাপিত জীবনে যদি অনুসরন করতে পারি তা হবে উনাক সম্মান, শ্রদ্ধা ও স্মরণ করে সর্বৎকৃষ্ট ।
বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যিনি মূল কারিগর ও স্বাধীনতা অর্জনের পর ’৭৫ সালে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে বিশ্ব ইতিহাসের কলংকময় সেই রাতে শহীদ হওয়ার আগে পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পরতে পরতে যে সকল সমস্যা ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তিনি তার বক্তৃতায় ও তার লেখা বই এ তুলে এনেছেন যার অধিকাং থেকে আমরা আজো মুক্তি পাইনি।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন যদিও সরকারি ব্যক্তি বর্গের কাছে দেশে সাধারণ মানুষ কোন সম্মান ও মর্যাদা পায় না। এদিকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।
সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আল্লাহর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আমি আপনাদের জাতির পিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনি এই ব্যাপারে কঠোর হবে বলে আশা রাখি।
বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তিনি এক বক্তব্যে দেশব্যাপী ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারীদের দৌরাত্ন্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩ বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোরে নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দু:খ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই।“ প্রধানমন্ত্রী কাছে অনুরোধ যে দুঃখে বঙ্গবন্ধু পাগল হয়ে যেতেন, মানুষের সেই দুঃখ দূর করতে আপনি নির্দেশ দেবেন ও সেই কাজ তদারকি করবেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ফেব্রয়ারী মাসে সিরাজগঞ্জে এক জনসভায় বলেন “শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি যে কোনো দিন আর শোষকেরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না ইনশা আল্লাহ। দ্বিতীয় কথা, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ চালাবে, এর মধ্যে কারও কোনো হাত থাকা উচিত নয়। তৃতীয়, আমি বাঙালি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই সম্মানের সঙ্গে। চতুর্থ, আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, বুদ্ধিস্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। তবে একটা কথা হলো, এই ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না।“ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, এদিকে দেশ দিনে দিনে কট্টর ইসলামিক রাষ্ট্রে রুপান্তর হচ্ছে আপনি এই মুজিব বর্ষে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ যেন ধর্ম নিরপেক্ষ হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা বই দুটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচা আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করুন, যাতে কিশোর যুবকরা তার মতাদর্শ পড়ে নিজেদের জীবন সাজাতে পারে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে এক -ভাষণে বলেছিলেন, আত্মসমালোচনা করতে,“দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া-কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা”।
আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেছিলেন,“আজকে এই যে নতুন এবং পুরান যে সমস্ত সিস্টেমে আমাদের দেশ চলছে, আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন আছে। আত্মসমালোচনা না করলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না। আমরা ভুল করেছিলাম, আমাদের বলতে হয় যে, ভুল করেছি। আমি যদি ভুল করে না শিখি, ভুল করে শিখব না, সে জন্য আমি সবই ভুল করলে আর সকলেই খারাপ কাজ করবে, তা হতে পারে না। আমি ভুল নিশ্চয়ই করব, আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে থাকতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি যে, না আমি যেটা করেছি, সেটাই ভালো। দ্যাট ক্যান নট বি হিউম্যান বিং”।
১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দেওয়া ভাষণে তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, এখনো কিছুসংখ্যক লোক, এত রক্ত যাওয়ার পরেও যে সম্পদ আমি ভিক্ষা করে আনি, বাংলার গরিবকে দিয়ে পাঠাই, তার থেকে কিছু অংশ চুরি করে খায়। এদের জিহ্বা যে কত বড়, সে কথা কল্পনা করতে আমি শিহরিয়া উঠি। এই চোরের দল বাংলার মাটিতে খতম না হলে কিছুই করা যাবে না। আমি যা আনব এই চোরের দল খাইয়া শেষ করে দেবে। এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।
গণতন্ত্র, বিরোধী দল, বাক্ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, দেশে কোর্ট-কাচারি আছে, আছে প্রচলিত আইন এবং কাউকে শাস্তি দিতে হলে যথাযোগ্য বিচারের মাধ্যমে সেটা দিতে হবে। আমরা জানি যে বিগত সাত বছর এই পবিত্র সংসদের অনেক সদস্যকে বিনা বিচারে জেলে নেওয়া হয়েছে। একজন মাননীয় সদস্য পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন, তাঁকে পাকিস্তানের স্বার্থে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।পাকিস্তান গণপরিষদের করাচি অধিবেশনে ইসলামিক রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সম-অধিকার বিষয়ে আলোচনায় বলেন, “আমাদের টেলিফোন টেপ করা হয় এবং চিঠিগুলো পুনরায় সেন্সর করা হয়। আপনারা বলে থাকেন যে বাক্স্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আপনি কি জানেন যে পূর্ববঙ্গে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয় আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না; আপনারা ওটা ছাপতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি। পূর্ব বাংলা সরকার লিখুক আর একজন কেরানি লিখুক, সেটা বড় কথা নয়। নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে যে আপনি বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবেন না। সরকারের তরফ থেকে একজন ইন্সপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।“
৩০ জুন ১৯৬৬, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।’ বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই। এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে, ভাবতেও ভয় হয়। আজ দলমত-নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসেখেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক’।
নারীর প্রতি আস্থা ও সম্মান বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে”।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদের প্রতি তিনি বলেন, ছাত্র ভাইয়েরা, লেখাপড়া করেন। আপনাদের লজ্জা না হলেও আমার মাঝে মাঝে লজ্জা হয় যখন নকলের কথা আমি শুনি। ডিগ্রি নিয়ে লাভ হবে না। ডিগ্রি নিয়ে মানুষ হওয়া যায় না। ডিগ্রি নিয়ে নিজের আত্মাকে ধোঁকা দেওয়া যায়। মানুষ হতে হলে লেখাপড়া করতে হবে। আমি খবর পাই বাপ-মা নকল নিয়া ছেলেদের-মেয়েদের এগিয়ে দিয়ে আসে। কত বড় জাতি। উঁহু! জাতি কত নিচু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় দেওয়া ভাষণে বলেন, “রাস্তা নেই ঘাট নেই, রেলওয়ে ব্রিজ এখন পর্যন্ত সারতে পারি নাই। চরিত্র এত জঘন্য খারাপ হয়ে গেছে যেই ধরি পকেটমাইর ধরি, চোর-গুন্ডা ধরি, লজ্জায় মরে যাই ছাত্রলীগের ছেলে, ভাই-বোনেরা। পুলিশ দিয়া নকল বন্ধ করতে হয় আমার এ কথা কার কাছে কবো মিয়া? এ দুঃখ! বলার জায়গা আছে মিয়া? তোমরা নকল বন্ধ করো। ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন নিয়া সংগ্রাম পরিষদ করেছ, তোমরা গার্ড দিয়া নকল বন্ধ করো। তোমাদের আমি সাহায্য করি। পুলিশ দিয়া আমাদের নকল বন্ধ করতে দিয়ো না তোমরা। পুলিশ দিয়ে আমি চোর সামলাব”।
১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট, ঢাকায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া ভাষণ দান কালে তিনি বলেন, আমি দেখতে চাই যে, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন ফার্স্টক্লাস বেশি পায়। আমি দেখতে চাই, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন ওই যে কী কয়, নকল, ওই পরীক্ষা না দিয়া পাস করা, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলো।
বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শের ছিতে ফোঁটা যদি দলের সব নেতা-কর্মী পালন করে তাহলে দেশে যে উন্নয়ন চলছে তা হবে টেকসই, মজবুত ও দীর্ঘমেয়াদী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ দলের আদর্শবান সৎ নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে তাদের সঠিক মর্যাদাদান ও সুযোগ সন্ধানী, হাইব্রিড, ন্যায়-নীতি বর্জিত কর্মীদের শাস্তি প্রদান করুন।
বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা, আদর্শ, ন্যায়-নীতি, জীবন, চিন্তা, শিক্ষা ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমাদের সরকার পরিচালিত হয় এবং তার যথাযথ পালন হয় তা হলেই মুজিব বর্ষ সফল হবে বলে দৃশ্যত। আর সেই লক্ষ্যে যদি অটুট থাকা যায় তাহলে বাংলাদেশ অচিরের একটা সোনার দেশ হয়ে গড়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)