মামলা ও আদেশের বিষয়ে না জেনে ‘ব্লেইম দেয়া’ কোর্টের জন্য বিব্রতকর উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘একটি ফাঁসি দেয়ার আগে আমরা ১০ বার চিন্তা করি।’
জেল আপিল খারিজ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুরের পর ফাঁসি কার্যকর হওয়া মকিম-ঝড়ুর আলোচিত আপিলটি ‘অকার্যকর’ বলে তা খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ বুধবার এই আদেশ দেন।
এর আগে শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই যে মকিম ও ঝড়ুর বিষয়ে বিস্তারিত না জেনেই আইনজীবী বলে দিলেন…। ব্লেইম দেয়া, এটা তো কোর্টের জন্য বিব্রতকর। আমরা কিন্তু একটা ফাঁসি দেয়ার আগে আমরা ১০ বার চিন্তা করি।’
এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে পরে আসামি পক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতকে বলেন, ‘কোর্টকে ব্লেইম দেইনি। তবে আমাদেরও ভুল হতে পারে।’
একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই যে আজকের কার্যতালিকার ৭ নম্বর আইটেমে সুজনের যে বিষয়টি, সেখানে তো তার জেল আপিল শুনানিতে আইনজীবী আর্গুমেন্টই করেনি। তবে তার জেল আপিলটি আমরা শুনে তাকে (সুজনকে) খালাস দিয়েছি। কিন্তু তার রেগুলার আপিলটি রয়ে গেছে।’
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে এখনো সবকিছু ডিজিটাল হয়নি। ডিজিটাল হলে সাথে সাথে ডিটেক্ট করা যেত যে কোন মামলার কোনটা থেকে কোনটা এসেছে। কিন্তু আমাদের এখানো তো ডিজিটাল হয়নি, এটাই সমস্যা।’
এসময় আদালতে আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আসিফ হাসান। আর রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড, দু’জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অপর আসামিদের খালাস দিয়ে রায় দেন চুয়াডাঙ্গার আদালত। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন: আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু। পরবর্তীতে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ও আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে পরে মোকিম ও ঝড়ু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল ও জেল আপিল করেন। সম্প্রতি মোকিম ও ঝড়ুর আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে।
এ বিষয়ে গত ৩ নভেম্বর আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন যে, ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।’ পরবর্তীতে এই সংবাদ প্রকাশ হলে আলোচনার ঝড় ওঠে।
ঘটনার প্রেক্ষিতে যশোরের কারা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলে, সব আইন মেনেই ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর কারাগারে মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
পরবর্তীতে গত ৪ নভেম্বর রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন: ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম আসামি মকিম ও ঝড়ু জেলখানা থেকে যে আপিল করেছিলেন, সেটি ছিল জেল আপিল। তিনজন বিচারপতি শুনানি করে সে জেল আপিল ১৫ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে রায়ের মাধ্যমে খারিজ করে দেন। কিন্তু আসামিরা আর একটি (নিয়মিত) আপিল করেন, যেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ছিল। যেহেতু এই আপিলটি আলাদাভাবে করা হয়েছে একসাথে ট্যাগ করা হয়নি, এই কারণে এটি রয়ে গেছে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন: ‘আসামি পক্ষের আইনজীবীদের উচিত ছিল দুটি আপিল একসঙ্গে শুনানি করা বা আদালতের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা। যেহেতু তারা আদালতের দৃষ্টিতে আনেননি, তাই যে জেল আপিলটি এসেছিল তা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি হয়ে খারিজ হয়েছে। বিচার তো হয়ে গিয়েছে। আদালতে তাদের আইনজীবীরা শুনানি করেছেন। আদালত সব কিছু শুনে বিচার করে (জেল আপিল) খারিজ করে দিয়েছেন। পরে আসামিরা রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলে সেটিও খারিজ হয়েছে। আপিল এবং প্রাণ ভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পরেই স্বাভাবিকভাবে আসামিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।’