চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পিলখানা হত্যা মামলা: আপিলের সামনে খরচের পাহাড়

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে সামনে আসছে বিশাল এক খরচের পাহাড়।

এই মামলার বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন: এই মামলায় হাইকোর্টের দেয়া ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প যুক্ত এক সেট ফটোকপি নিতেই ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫৫৪ টাকা খরচ হবে। আর যদি রায়ের এক সেট সার্টিফায়েড কপি নিতে হয়, তাহলে খরচ বাড়বে কয়েক গুণ তথা কয়েক লাখ টাকা। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত রায়ের কপির জন্য দরখাস্ত করেছে ৩২৬ জন।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন: এই মামলায় হাইকোর্টের দেয়া খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আপিল করবে। আর অন্যান্য আসামি যারা আছে তাদের পক্ষে রায়ের কপি বাবদ এত টাকা ব্যায় করা সম্ভব হবে কিনা এটা একটা চিন্তার বিষয়। তবে বিষয়টির সমাধান কিভাবে করা যায় সে ব্যাপারে আমি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব।

এদিকে আসামী পক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন: দলিলের কাগজের মত ‘ফলিও কাগজে’ রায়টির সার্টিফায়েড কপি নিতে হলে এই রায়ের পৃষ্ঠা বেড়ে ৬০ হাজার হতে পারে। যেখানে প্রতি পৃষ্ঠায় ১৪ টাকা করে খরচ হবে। এই হিসাবে ৬০ হাজার পৃষ্ঠার কপি তুলতে ৮ থেকে ৯ লক্ষ টাকা লাগবে।

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এটা তো বললাম ‘ফলিও কাগজে’ রায়ের একটি সার্টিফায়েড কপি তোলার খরচের কথা। তবে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল উপস্থাপন করতে গেলে সার্টিফায়েড কপির সাথে নিম্ন আদালতের রায়ের অনুলিপি এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যের অনুলিপিসহ আপিলের নানা যুক্তি সম্বলিত কাগজ যুক্ত করতে হবে।

২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের সাথে আরো হাজার হাজার পৃষ্ঠা বেড়ে একটি পেপারবুক হবে। আপিল শুনানির ক্ষেত্রে এই পেপারবুকের আবার ১৪টি করে কপি প্রয়োজন হবে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিটা আলাদা আপিলে কাগজ ও কপি কেন্দ্রিক খরচ দাঁড়াবে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। যেটাকে পাহাড় সমান খরচ বলা চলে।

এর আগে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন এবং বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন। এই তিন বিচারপতির সাক্ষরের পর গত ৮ জানুয়ারি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর সে রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ওঠে।

হাইকোর্ট তার রায়ে পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আর ২০০ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। এছাড়া হাইকোর্ট তার রায়ে এই হত্যা মামলা থেকে ৪৫ জনকে খালাস দেন।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ শোনা যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন ভেতরে হয়ত কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু পরে জানা যায় ভেতরে বিদ্রোহ হয়েছে এবং পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর পাওয়া যায়।

একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এরপর গভীর রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

এর পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের। তবে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া যায়। আর বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর নাম বদলে এই বাহিনী নাম দেয়া হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ওই বিদ্রোহের ঘটনার পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু পরে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকার বিচারিক আদালতে। দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এছাড়া সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। পরবর্তীকালে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। ৩৭০ কার্যদিবস শুনানির পর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।