পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) ঋণ গ্রহীতা পিকে হালদার এবং প্রতিষ্ঠানটির ১৯ জনের পাসপোর্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেন।
আদালতে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব-উল আলম। আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
এর আগে বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগের নির্দেশ দেন।
এছাড়া হাইকোর্ট তার আদেশে পিকে হালদারসহ ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ২০ কর্মকর্তার পাসপোর্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেন। সেই সাথে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই ২০ কর্মকর্তার নগদ অর্থ, গাড়ি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পিকে হালদারসহ ২০ জন হলেন- কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. নুরুল আলম, পরিচালক জহিরুল আলম, এমএ হাশেম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জী, পাপিয়া ব্যানার্জী, মোমতাজ বেগম, নওশেরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নরুজ্জামান, আবুল হাশেম, মো. রাশেদুল হক, পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, চাচাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও পিকে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী।
হাইকোর্ট তার আদেশে বলেন: ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে কোম্পানিটিকে (আইএলএফএসএল) দেউলিয়া ঘোষণা করার পরিবর্তে যদি অভিজ্ঞ, সৎ, দক্ষতা সম্পন্নদের দিয়ে কোম্পানিটির ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেয়া যায় তাহলে বরং কোম্পানিটির অংশিদার ও আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।’
ওই আদেশের পর আইএলএফএসএল -এর চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার ইব্রাহীম খালেদকে নিয়োগ দেয়া হয়।
এর আগে আইএলএফএসএল এর আমানতকারীরা তাদের আমানতের টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদন করলে তাদের জানানো হয় আইএলএফএসএল আমানতের টাকা দিতে অক্ষম। ওই পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা কোম্পানিটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন।
সর্বশেষ আইএলএফএসএল আদালতে একটি লিখিত দিয়ে বলে, বর্তমান অবস্থায় একসাথে সমস্ত পাওনাদারদের পাওনা তারা পরিশোধ করতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে আইএলএফএসএল -এর সাত বিনিয়োগকারী টাকা ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। সে আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ইব্রাহীম খালেদকে নিয়োগ এবং পিকে হালদারসহ ২০ জনের বিষয়ে আদেশ দেন।
তবে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে আইএলএফএসএল। সে আবেদন শুনানির একপর্যায়ে আপিল বিভাগ আইএলএফএসএল এর বিষয়ে বিস্তারিতভাবে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ও খন্দকার ইব্রাহীম খালেদকে ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থিত হতে বলেন। সে সময় সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘ব্যাংকসহ দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দেখে আদালত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।’
এরপর গতকাল ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধিন আপিল বেঞ্চে উপস্থিত হয়ে আইএলএফএসএল সম্পর্কে মতামত ও তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম এবং আইএলএফএসএল এর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ।
আইএলএফএসএল বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম সর্বোচ্চ আদালতকে বলেন: ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মূলধনে ৪৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ঋণ আছে ৯৫৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার। সর্বমোট ঋণ ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।’
‘বিধি বহির্ভূতভাবে’ টাকা নিয়ে যাওয়ায় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে মো. শাহ আলম আদালতকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এছাড়া মোট ৪৮টি ঋণ হিসাবের সঙ্গে ১২টি প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ব্যক্তির বিপরীতে মোট ১৫৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই ৪৮টি ঋণ হিসাবের লেনদেন ভাউচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সুবিধাভোগী কারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, ‘আমরা দেখলাম একজনই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আপনাদের হিসাব কি শুভঙ্করের ফাঁকি?’
‘৩৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট’ শিরোনামে পিকে হালদারকে নিয়ে সম্প্রতি পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
তবে প্রশ্নের উত্তরে শাহ আলম বলেন, ‘পিকে হালদারসহ অন্যরা এই কোম্পানি থেকেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আমরা পাইনি।’
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে আদালত জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘আমরা তাদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা ও শোকজ করেছি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’
বাংলাদেশের ব্যাংকের এই নির্বাহী পরিচালক এক পর্যায়ে সর্বোচ্চ আদালতকে বলেন যে, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছি।’
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রহীম খালেদ গতকাল মঙ্গলবার আপিল বিভাগকে বলেন, ‘২০১৫ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটড ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন কোম্পানির কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার হালদার। আর তার সঙ্গে আরও অনেকেই রয়েছে। যারা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। বের করে দেওয়া মানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, আবার কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে।’
খন্দকার ইব্রহীম খালেদ গতকাল আপিল বিভাগকে আরো বলেন, ‘পিকে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছে। সর্বশেষ কোন ব্যক্তি পর্যন্ত এই টাকা পৌঁছালো তা জানি না। টাকা কোথায় আছে সেটা আনট্রেসেবল। দেশেও থাকতে পারে, দেশের বাইরেও যেতে পারে। তবে এই টাকা উদ্ধার করতে রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের এজেন্ট দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।’
তবে বর্তমান অবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানিকে দাঁড় করানো যাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে খন্দকার ইব্রহীম খালেদ আদালতকে বলেন: ‘আমি সন্দিহান। আমি সাহস পাচ্ছি না। আমি তো এই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার নই। হাইকোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারব! সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে আমি কী করতে পারি!’
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কোম্পানি সংক্রান্ত শুনানিতে গতকাল আদালতকে বলেন: ‘আগে তো ব্যাংক ছিল না। মানুষ গোলায় ধান রাখত। এটাই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট। কিন্তু মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখে। আর অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য। এরা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এদের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া।’
২৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বেঞ্চে এসব বক্তব্য উপস্থাপন ও শুনানির পর সর্বোচ্চ আদালত বুধবার আদেশের দিন ধার্য করেন।