বিজেপি কোনো বিষয়ই নয়। আসল হল আরএসএস। সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির একমাত্র কাজ, সঙ্ঘের তথাকথিত আদর্শগত বিষয়গুলির প্রয়োগ।
বিজেপি নবান্ন অভিযানে কোনো ছাপ রাখতে পারেনি বলে উদ্বাহু হওয়ার কোনো অর্থ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় দশ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হাজারগুণ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন প্রশ্নটা হল, মোহন ভাগবতেরা (সঙ্ঘ প্রধান) কী চান? তারা কি চান, সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সরাসরি ক্ষমতায় এলেই গোটা দক্ষিণ এশিয়াটিকে মার্কিন প্রভুদের মুক্তাঞ্চল করে দেওয়ার কাজটি বেশি সুবিধাজনক হবে? নাকি, তাদের দুঃসময়ের বন্ধু, কখনো শৌখিন সমালোচক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এই রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে গেলে, আখেরে সঙ্ঘের লাভ বেশি। সেই হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গে আর এস এস হয় শক্তিশালী করবে বিজেপিকে, নতুবা বাচ্চাদের লুকোচুরি খেলার দুধভাতের মতো আচরণ করবে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে। তৃণমূলও সেই আচরণেরই সমুচিত মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করবে বিজেপির সাথে, কারণ; তৃণমূলের টিকির শক্ত বাঁধন যে নাগপুরের রেশমবাগের কেশবভবনে বাঁধা আছে।
পশ্চিমবঙ্গের অবিজেপি রাজনীতিকেরা বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএস, কিভাবে বাংলায় নিজেদের নখদন্ত বিস্তার করেছে, সেই সম্পর্কে কতোখানি সম্যক ধারণা করতে পেরেছেন, তা নিয়ে সত্যিই একটু সংশয় জাগে। বামপন্থী রাজনীতিক মহঃ সেলিমের মতো মানুষ, যিনি নিজের রাজনৈতিক জীবনের একটা বড়ো অংশ বাংলার পাশাপাশি দিল্লিসহ গোটা উত্তর ভারতে কাটিয়েছেন এবং গত চল্লিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন, তাদের ভিতর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিন্দি ও উর্দু বক্তা, তিনি যেভাবে আরএসএসের বিপদটাকে উপলব্ধি করেন, জ্যোতিবাবু উত্তর প্রজন্মের বাম, অবাম কোনো নেতাই সেভাবে উপলব্ধি করেন না। আজ বাংলা মুলুকে মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এখানে সঙ্ঘের এতোখানি ব্যাপ্তি ঘটেছে। এই ব্যপ্তির যে আঙ্গিক, সেটি সঙ্ঘ কার্যত ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রায় অব্যবহিত পর থেকেই গোটা হিন্দি বলয়ে ঘটিয়ে চলেছে। সেই ব্যাপ্তিটা উপলব্ধির জন্যে হিন্দি ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে একটা নিবিড় সংযোগ দরকার। তেমন সংযোগ জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, গীতা মুখার্জী, সইফুদ্দিন চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বদের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের ভিতর একমাত্র আছে মহঃ সেলিমের। তাই তিনি মমতা ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত তৈরিতে যেখানে যেমন, সেখানে তেমন কর্মধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে কী ধরণের ষড়যন্ত্র আরএসএস করছে, সে সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছিলেন।
বস্তুত হিন্দি বলয়ে আরএসএসের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধরণ না দেখলে, রীতিনীতি অনুভব না করলে, বাংলায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভিতর দিয়ে, নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভোট রাজনীতিতে ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশে আরএসএস কী ধরণের ন্যাক্কারজনক কাজ করে চলেছে, তা বোঝা সম্ভবপর নয়। কেবল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারই নয়, মুসলিম বিদ্বেষ, যেটি আরএসএসের মেরুকরণের রাজনীতির সবথেকে বড় হাতিয়ার, সেটির প্রয়োগে মুসলমান মাংস বিক্রেতা থেকে দর্জি, এমনকি বাড়িতে যেন মুসলমান পরিচারক, পরিচারিকা না রাখা হয়, মুসলমানের মালিকানাধীন হোটেল, রেস্টুরেন্ট বর্জন- কিনা সামাজিক বিষ আরএসএস হয় নিজেরা সরাসরি, না হয় তাদের হাজার রকমের শাখা সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার করতে করতে সাধারণ মানুষের মনে ধর্মীয় বিভাজনকে একটা ভয়াবহ জায়গাতে পৌঁছে দিয়েছে, তা ভাবা ও যায় না। সেলাই করা লুঙ্গি পরিহিত কোনো মানুষ হিন্দুদের দেবস্থানে এলে, সেই ব্যক্তিকে ঘিরে বিভাজনের হলাহল ছড়ানো হচ্ছে। অথচ সেলাই না করে, কাপড় ভাঁজ করে কোনো মানুষ যদি হিন্দুদের দেবস্থানে যায়, তাহলে সেই পোষাক হিন্দুধর্মে অনুমোদিত, তাই সেই আগন্তুককে ঘিরে কোনো ওজর আপত্তি করা হচ্ছে না।
এই ধরণের হাজারো বিষয়, যেগুলির সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতির ন্যুনতম সংযোগ নেই, বাংলার সংস্কৃতির এতোটুকু সম্পর্ক নেই, সেইসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলিকেই কেবল সংস্কৃতি নয়, ধর্মের আঙ্গিক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলার মানুষের ধর্মাচারের সঙ্গে এইসব অপ্রাসঙ্গিক, সাম্প্রদায়িক, বিভাজনমূলক বিষয়গুলিকে একাত্ম করে ফেলে ধরা হচ্ছে আরএসএসের বিভিন্ন প্রকারের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের এই সামাজিক প্রযুক্তি সম্পর্কে হয় সম্যকভাবে অবহিত হন। এই পদ্ধতির ভিতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির অত্যন্ত দুঃসময়েও সঙ্ঘ কিভাবে অত্যন্ত ধীরে, গভীর ধৈর্যের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়ে হিন্দি বলয়ে ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপিকে সুবিধাজনক অবস্থায় এনে দিয়েছে, সে বিষয়টিকে মহঃ সেলিমের মতো সর্বভারতীয় স্তরে সম্যক খবরাখবর রাখা বামপন্থী নেতা জানেন। কিন্তু সেলিমের মতো দু একজন হাতে গোটা বামপন্থী নেতা সঙ্ঘের এই সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়টি এবং সে থেকে কী ধরণের বিপদ আসতে পারে, তা জানলেও, সমস্ত অবিজেপি নেতারা এই বিপদটাকে হয় উপলব্ধি করতে পারছেন না। নয় তো এই বিষয়টি ঘিরে তাঁরা তেমন কিছু জানেন ই না। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব ই দিচ্ছেন না। রাজ্য বিজেপি নেতাদের কিছু অরাজনৈতিক মন্তব্য ঘিরে শোরগোল তুলে, সেই সব কথা ঘিরেই ফেসবুকে নানা ধরণের পোস্ট, যাকে আজকের প্রজন্মের ভাষাতে ‘খিল্লি’ বলা হয়, সেভাবেই গোটা পরিস্থিতিকে বিচার করছেন। ফলে কার্যত রাজ্যের শাসকদলের প্রচ্ছন্ন মদতে আরএসএস অত্যন্ত নিভৃতে অথচ প্রবল দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিতর দিয়ে বিজেপির ভোট রাজনীতিতে যে সুযোগ করে দিচ্ছে, সেই বিষয়টি সম্পূর্ণ অনালোচিতই থেকে যাচ্ছে।
তৃণমূল কংগ্রেস এখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায়। ফলে পুলিশ ও শাসক তৃণমূলের করায়ত্ত। তাই আরএসএস তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভাজনকে প্রসারিত করে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে আসন্ন বিধানসভার ভোটে কী ধরণের সুবিধা করে দিতে কাজ করে চলেছে, সেটা পুলিশের মাধ্যমে প্রশাসন, তথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এতোটুকু অজানা নয়। সঙ্ঘের এই সামাজিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে গত প্রায় দশ বছর, যে সময় ধরে ক্ষমতাপশ্চিমবঙ্গ শাসন করছেন, সেই সময়কালে একটি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, রাজনৈতিক কর্মসূচি যদি প্রতিদ্বন্দ্বী নেন, তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে যাবে শাসক দল? সেটা তো রাজ্যের শাসকদলের একটি অগণতান্ত্রিক কাজ হবে। রাজ্যের শাসক বামপন্থীদের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি কড়া হাতে দমন করেন। কংগ্রেসের কর্মসূচি ও দমন করেন। এমনকি দেখা গেল, সাম্প্রতিককালে (৮/১০/২০২০) বিজেপির নবান্ন অভিযান ও খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে দমন করার একটা অভিনয় মমতার প্রলাসন করলেন। অথচ সামাজিক কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, ধর্মীয় কর্মসূচির নাম করে যে মারাত্মক হিন্দু সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি আরএসএস নিজে বা তাদের সহযোগী সংগঠনগুলির ভিতর দিয়ে পালন করে থাকে, যে পালনগুলি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী। কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন এতোটুকু উদ্যোগ নেয় না। মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস তো সেগুলির বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচি গত দশ বছরে একটিবারের জন্যেও পালন করেনি। বরঞ্চ আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এগিয়ে দিতে রামনবমীর মতো কর্মসূচি সশস্ত্রভাবে পালিত হলে, তৃণমূল কংগ্রেস তার পাল্টা হিসেবে পালন করে হনুমান জয়ন্তী। সমাজবিজ্ঞানীরা মমতা এবং তার দলের এই কর্মধারাকে অভিহিত করেছেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’ হিসেবে। বস্তুত সাম্প্রদায়িকতার প্রচার, প্রসার ,প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশভাগের পর এই ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’ আমদানি, ভারতীয় রাজনীতিতে মমতার একটি নতুন সংযোগ।
আর এস এসের কৌশলকে পূর্ণতা দিতে মমতার গভীর, গোপন যে কর্মধারা, সেগুলি তুলে ধরবার ক্ষেত্রে বাম- কংগ্রেস নেতৃত্বকে অনেক বেশি শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। কেবলমাত্র সভা, সমিতিতে বক্তৃতা আর ফেসবুকে বিজেপি নেতাদের লোক হাসানো কথাবার্তাকে ব্যঙ্গ করে প্রচারের ভিতর দিয়ে আরএসএস, বিজেপি এবং তাদের হাজারও রকমের শাখা সংগঠন, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’কে প্রসারিত করবার যে অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে, তাকে যথাযথভাবে এই মুহূর্তে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। আরএসএসের এই সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির পাল্টা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে, পাল্টা সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগ একান্ত জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)