বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে উচ্চকন্ঠ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আবেগ এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের অসততা, দুর্নীতি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন বাংলাদেশ লেখক ঐক্যের সভাপতি রাখাল রাহা।
ফেসবুকে রাখাল রাহা লিখেছেন,
“অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিশুসাহিত্য করেন। তিনি অনেকটা শিশুর মতো। তাঁর সারল্য দেখে মনে হয়, তিনি মনে করেন যে-কোনো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ভালো কিছু চালু করলেই সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালো ফল দিতে শুরু করে! ভালো কিছুর ক্ষমতা এমন যে তা ব্যবস্থা-নিরপেক্ষ! অর্থাৎ একটা পতিত ব্যবস্থার মধ্যেও তা অবধারিতভাবে ভালো ফল দেবেই!
সেমিষ্টার পদ্ধতি, ফলাফল নির্ধারণে জিপিএ পদ্ধতি বা সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি, কিংবা মহান শিক্ষানীতি গ্রহণ, ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে এনেছে এটা কেউ বলেন না। তিনি নিজেও বলেন না। কেন খারাপ ফল বয়ে আনছে এজন্য তিনি নানা পর্যায়ের অসততা, প্রশ্নফাঁস, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া, গাইডওয়ালাদের অপকর্ম ইত্যাদি বহু কথা লিখেছেন।
কিন্তু এটা বুঝেও তিনি অনেকদিন থেকে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একই দিনে নেওয়ার দাবী উত্থাপন করে আসছেন। এক্ষেত্রেও তাঁর বিবেচনার মূল বিষয় হচ্ছে ছেলেমেয়েদের কষ্ট লাঘব করা।
কিন্তু বুয়েটের পরীক্ষা রাজশাহী বসে দিতে পারা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কুষ্টিয়ায় বসে দিতে পারার সুবিধার সাথে প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরো কি কি অতি ‘সুবিধা’ (!) সৃষ্টি হতে পারে তা তাঁর সরল দাবীর ক্ষেত্রে একেবারেই বিবেচনার বিষয় থাকছে না।
কিছুদিন আগে তিনি লিখেছেন, থানা কেন অপরাধের মামলা নেয় না, এটা তিনি বুঝতে পারেন না — অনেকটা এরকম কথা। আসলেও একজন শিশুর মতো ‘সাদাসিধে’ মানুষের পক্ষে এটা বোঝার কথা নয়।
এই রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকেই যে অসৎ, অদক্ষ আর অকার্যকর করে তোলা হয়েছে এবং এটা যারা করেছে ও যাদের বিরুদ্ধে থানা মামলা নেয় না, এদের দু’পক্ষের সাথেই যে ক্ষমতাকেন্দ্রের কোনো-না-কোনো সুতোর যোগ আছে এটা তিনি বুঝতে পারেন না।
তিনি বুঝতে পারেন না, এক গামলা পচা দুধে বালতি বালতি ভালো দুধ ঢেলে সেটাকে ভালো করা যায় না। আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে বহু দিন ধরে অশিক্ষিত-বখাটে রাজনীতি, ধান্ধাবাজ-চাটুকার প্রশাসন আর উন্নয়ন-বাণিজ্যিক সংস্থার খপ্পরে ফেলা হয়েছে। এখানে ব্যক্তির সততার জায়গা থেকে সমষ্টির মধ্যে খুব কিছু করার সুযোগ প্রায় নেই হয়ে গেছে। তাই এর মধ্যে যা কিছু আজ আলো ফেলা হয় তার উৎপাদন হয় আরো অন্ধকার।
অন্ধকারের এই উৎপাদন এখানে অনেকটা স্বতঃসিদ্ধের মতো হয়ে গেছে। তাই আলোর ফর্মুলা যিনিই হাজির করেন, তা যদি এই ব্যবস্থার পরিচালকেরা বোঝে যে এতে তার ধান্দা হবে, তবে তারা তা বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প ফেঁদে ফেলে।
আর যেহেতু জিপিএ-জালিয়াতির কারণে তারা উচ্চ শিক্ষাস্তরে এখনো জিপিএ-ভিত্তিক ভর্তি প্রচলন করতে পারেনি, সুতরাং অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফর্মুলা তারা গিলে ফেলতে পারে। গিলে ফেলে লেজেগোবরে করে যদি আবার বলা হয় আগের অবস্থা ফিরিয়ে দাও, সেটাও তারা একসময় করে দেবে! কারণ যত ভাঙাভাঙি তত ফায়দা তাদের!
এই যে অবস্থা, এটা তিনি বুঝলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ভালো হতে পারতো। কারণ শিক্ষাবিদদের কাছে একমাত্র ‘না-শিক্ষাবিদ’ তিনিই, যাঁকে আমরা দেখি শিক্ষাবিদের বহু কিছিমের ধান্দা না বুঝে বিভিন্ন শিক্ষা-দুর্যোগে শিশুর মতো এগিয়ে যেতে। আর নিরন্তর কথা বলতে, লিখতে, শহীদ মিনারে গিয়ে ভিজতে-পুড়তে।
কিন্তু এতদিন পরেও তিনি বুঝতে পারেন না, এসব আবেগে গলে যাওয়ার মতো অপরিপক্কতার কাল শাসকশ্রেণী অনেক আগেই পার করে এসেছে। বুঝতে পারেন না, এটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের ইস্যু নয়। সাধারণের শিক্ষা ধ্বংসে সব পক্ষের ঐক্য আছে এবং এই ধ্বংস পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।”