নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে বিএনপির লাভ-ক্ষতি দু’টোই হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, এ নির্বাচনে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পেরেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত যে যৌক্তিক ছিলো সেটাও প্রমাণ করতে পেরেছে বিএনপি। তবে অন্যপক্ষ বলেছে, ভুল সময়ে বর্জনের ডাক দিয়ে বিএনপি একদিকে তাদের ভোটারদের হতাশ করেছে, অন্যদিকে এটাও প্রমাণ হয়েছে যে আন্দোলনের মতো নির্বাচনী লড়াইয়েও কর্মীদের মাঠে নামাতে অন্যতম বৃহৎ এ দলটি ব্যর্থ।
নির্বাচনের আগে জোর প্রচারণার মধ্যেই ছিলো বিএনপি।নির্বাচনী ক্যাম্পে রূপ পাওয়া স্থানীয় কর্যালয়গুলোতে অনেকদিন পর স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিলো। কিন্তু ভোটের মাঝামাঝি সময়ে সিটি নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। কর্মীদের মনে এখন প্রশ্ন: নির্বাচন বর্জনের এই সিদ্ধান্ত কি ভালো কিছু বয়ে আনবে বিএনপির জন্য? নাকি আরো খারাপই হলো?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাঈমুল ইসলাম খান বিএনপির বর্জন সিদ্ধান্তকে কেবল প্রতিবাদের ঘোষণা হিসেবেই আখ্যায়িত করতে চান। তিনি বলেন, নির্বাচনের এই পর্যায়ে এসে নির্বাচন বর্জন করা যায় না। নির্বাচনের আগের দিনও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়েছেন। এমন কোনো আইন নেই যে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর নির্বাচন বর্জন করা যায়।
‘বরং আমরা বলতে পারি যে এটা তাদের প্রতিবাদ ছিলো। ভোট নিয়ে নানান অভিযোগের কারণে তারা এই প্রতিবাদ জানিয়েছে। আমি মনে করি এই প্রতিবাদ জানানোর অধিকার তাদের আছে।’ বিএনপির সিদ্ধান্তকে এভাবে দেখলেও সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলছেন: বিএনপি এভাবে নির্বাচন থেকে সরে গিয়েই বা কি লাভ হলো? নির্বাচন শেষ হয়েছে, তার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে, গেজেটও হচ্ছে। এমন তো নয় যে, নির্বাচন বর্জনের ফলে আবার নির্বাচন করতে হবে।
৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেটা ছিলো সত্যিকারের নির্বাচন বর্জন। সিটি নির্বাচনের আগের দিনও বিএনপি বলেছে, কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে তারা সরে দাঁড়াবে না। আর পরের দিন নির্বাচন শুরু হতেই ১০টা/১১টার মধ্যে বর্জন করে ফেললো তারা।
তবে তিনি বলেন, বিএনপির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখতে গেলে তারা সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিবাদই করেছে। তারা ভাবছে, তারা জয়ী হতে পারতো, সেটা হতে দেওয়া হচ্ছে না বলেই তারা নির্বাচন বর্জন করেছে।
নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সুবিধাজনক স্থানে গেছে, আর আওয়ামী লীগ আপাত: চোখে ভোটে জয়ী হয়েও অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে করেন নাঈমুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতও এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে সত্যিকার অর্থে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গণতন্ত্র।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চেয়্যারম্যান ড. বশির আহমেদ মনে করেন, নির্বাচন বর্জন বিএনপির পূর্ব পরিকল্পনারই একটা অংশ। তবে তারা নির্বাচনে থাকলেই তাদের জন্য আরো ভালো হতো।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এখন ভালো না। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকলে সেটা তাদের জন্য ভালো কিছু ফল বয়ে আনতো।
তবে নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচন নিয়ে সরকারের কিছুটা ভীতি এবং প্রশাসনে উপর নির্ভরতা প্রমাণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন ড. বশির। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো। সেখান থেকে তারা জনগণের মনোভাব বুঝে নিজেদের সফলতার বিষয়গুলো মানুষের সামনে নিয়ে আসতে পারলে তাকে জোর করে কিছু বিষয় নিয়ে আসতে হতো না।
তার মতে, বিএনপি ভুল সময়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো। সেখান থেকে বেরিয়ে নির্বাচনে এসে বেরিয়ে যাওয়াটাও ভুল সময়ে হয়েছে। ।
তবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী। তার মতে, নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটা বিএনপির জন্য কার্যকর হয়েছে। নির্বাচন যতোটুকু খারাপ হবে বলে ভাবা হয়েছিলো তার চেয়েও বেশি খারাপ হয়েছে।
তিনি বলেন, সিটি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি প্রমাণ করলো, তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ তাদের ১০/২০টা সিট ধরিয়ে দিতো। সেটা নিশ্চয়ই সুষ্ঠু নির্বাচন হতো না।
তবে নুরুল আমিন ব্যাপারীও মনে করেন, বর্জনের সিদ্ধান্তটা একটু আগেভাগেই হয়ে গেছে। অল্প কিছুক্ষণেই নির্বাচনের যেসব অনিয়ম সবার চোখে ধরা পড়লো, সময় পেরোলে সেসব আরো বেশি করে ধরা পড়তো। পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে যেভাবে কারচুপি হয়েছে, সেসব জনগণের সামনে পুরোপুরি তুলে ধরতে দুইটা আড়াইটার দিকে ভোট বর্জন করলে বিএনপি কৌশলগতভাবে আরো লাভবান হতো বলে মন্তব্য তার।
নির্বাচন বর্জন করলো বিএনপি, কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হলো বলে মনে করেন নুরুল আমিন ব্যাপারী। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা তাদের দায়িত্ব। একাত্তর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। কিন্তু এখন গণতন্ত্র আওয়ামী লীগের হাতেই নস্যাৎ হচ্ছে।