জীবিকার তাগিদে ছুটছে সবাই। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এগিয়ে গেছে বহু দূর। পাল্টেছে জীবন। বদলে গেছে জীবিকার ধরনও। তার মধ্যেও আটপৌরে কিছু পেশা ধরে রেখেছেন অনেকে। তাদের এই পেশাগুলোকে সেবা বলা যায়। ব্যস্ত জীবনকে তারা সহজ করে তুলেছেন। চলতে ফিরতে তাদের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয়। ছোট ছোট গল্পে সহজে মিশে যাওয়া যায় সরল জীবনে।
পড়ালেহা বেশি শিখি নাই তাই মাছ কাডি
এই কৈ মাছগুলো কাটতে কত লাগবে?
-কট্টুক আছে?
দেড় কেজির বেশি।
-দেড়শ’ টাকা লাগবো।
কিছুটা দর কষাকষির পর রাজি হয়ে মাছ কাটা শুরু।
রাজধানীর আশকোনায় হজ ক্যাম্প বাজারে মাছ কাটে উজ্জ্বল ভুঁইয়া। বিশ একুশ বছরের হাসিখুশি উচ্ছল তরুণ। বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে। দিনভর দুরন্তপনা, ব্রহ্মপুত্র নদে সাঁতার কাটা আর মাছ ধরে কেটেছে শৈশব। পড়ালেখায় মনোযোগ কম ছিলো। ক্লাস এইটের পর আর এগোয়নি। এরপর জীবিকার খোঁজে ঢাকায় আসা। প্রথমে মাছ কাটার দোকানে আঁশটে তোলার কাজ করতো। ছ’মাসে মাছ কাটার কাজটা রপ্ত করে নেয়। এরপর বছর তিনেক ধরে নিজেই মাছ কাটার দোকান দিয়েছে। এখন তার দোকানে রাব্বি নামে বারো তেরো বছরের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। সে মাছের আঁশটে তুলে দেয়।
মাছ কাটতে গিয়ে হাত কাটেনি?
-হ, বহুবার। তখন বিরাট লস হয়। হাত না শুকানো পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকে। ডাক্তার আর ওষুধ-পাতি কিনতে খরচ হয়।
প্রতিদিন কয়টা থেকে মাছ কাটা চলে?
-এই ধরেন, বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
বিকেল পর্যন্ত কী কর?
-বিশ্রাম করি, ঘুমাই।
দিনে কত টাকার মাছ কাটো?
-একেক দিন একেক রকম, তয় ডেইলি দুই-আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম হয়।
মাসে লাভ থাকে কেমন?
-দোকান ভাড়া, রাব্বির বেতন আর অন্যান্য খরচ বাদ দিয়া তিরিশ হাজারের মতো থাকে।
কোন মাছ কাটায় কত নাও?
-ছোট মাছে বেশি টাকা লাগে। যেমন- কই, শিং, ট্যাংরা, টাকি মাছ। বড় মাছে কেজিতে ১০/১৫ টাকা কইরা নেই। অনেক সময় মাছ কাইট্যা বাড়িত পৌঁছায়া দেই। ওইটাতে আরো বেশি টাকা বিল হয়।
উজ্জ্বলের মা-বাবা, ভাইবোন বাড়ি থাকে। সে ঢাকায় থাকে ফুফুর সঙ্গে। ঘরভাড়া আর খাবার খরচ শেয়ার করে। বাড়িতে মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। কিছু টাকা জমিয়ে রাখছে। স্বপ্ন নিজে একটা মাছের দোকান দেবে। বিয়ে করবে, সংসার হবে।
বাদাম বেচি স্বাধীন মতো চলি
নাবিস্কো মোড়ে বাদাম বিক্রি করেন মো. ফারুক। দু’হাজার সাল থেকে এখানেই আছেন। ফুটপাথ দিয়ে চলতে গিয়ে বা বাসের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বাদাম খেতে মন্দ লাগে না। ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখে এই স্থানটা বেছে নিয়েছেন ফারুক। হাসিমুখে এগিয়ে দেন বাদাম। সঙ্গে চলে গালগল্প।
কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত বাদাম বিক্রি করেন?
-সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা।
দিনে আনুমানিক কত টাকার বিক্রি হয়?
-এই ধরেন গিয়া ১৮শ’ / ২ হাজার।
লাভ থাকে কেমন?
-৭শ’/ ৮শ’।
সপ্তাহে কেমন বিক্রি হয়?
-৭/৮ বস্তার মতোন।
বাদাম আনেন কোত্থেকে?
-চকবাজার থেকে।
দেশের বাড়ি?
-ভৈরব।
ভৈরব তো বাদামের জায়গা, ওখান থেকে আনেন না কেন?
-আনতে গেলে দাম বেশি লাগে। এই যেমন ধরেন, চকবাজার থাইক্যা আনতে যেইটা ১শ’ টাকা লাগে, ওইটা ভৈরব থাইক্যা আনতে ৫শ’ টাকা খরচ পড়বো।
কোথায় থাকেন?
-নাখালপাড়া রেললাইনের কাছে। দুই রুমের বাসা, ভাড়া ৮ হাজার টাকা। আমি, আমার আব্বা, ছোট ছেলে, ভাই আর পাড়ার আরো দুইজন মিইল্যা থাকি।
পরিবারের অন্যরা কোথায় থাকে?
-বাড়িত থাকে। আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বাড়িত লেখাপড়া করে। ছোডো ছেলেডার পড়াত মন নাই। গ্রামে থাকলে খারাপ হইয়া যাইতে পারে। তাই সাথে নিয়া আসছি। একটু দূরে সে-ও বাদাম ব্যাচে। ছোট থিকা টাকা চিনলে আর বিপথে যাইবো না।
এখানে বাদাম বিক্রির আগে কী করতেন?
-সিদ্দিকবাজারে জুতার ব্যবসা ছিলো। কিন্তু বার্মিজ জুতা বাজার দখল কইর্যা ফেলায় লাভ হয় না। দুই হাজার সাল থিকা বাদামের ব্যবসায় নামছি।
আরো তো অনেক ব্যবসা করা যায়, বাদাম কেন?
-এইটাতে কোন লস নাই, বাকির কারবার নাই। যা কিনবেন নগদ। আর মাল তো নষ্ট হয় না। ইচ্ছা মতোন ব্যবসা করি। ইচ্ছা হইলে বাড়িত যাই, আবার আসি। এইডা ভালো লাগে।
আপনার বয়স কতো?
-এই ধরেন ৫০ এর কাছাকাছি। কিন্তু আমারে দেখলে বুজা যায় না। স্বাস্থ্য ভালো তো। সবকিছু কাঁচা খাইতে পারি, মাছ-মাংস, জ্যান্ত পোকামাকড়।
জ্যান্ত পোকাও!
-হ, যেমন তেলচুরা।
কাঁচা খান কেন?
-এইটা আমার ভালো লাগে। আমারে নিয়া দুইডা টিভিতে রিপোর্টও হইছে।
আমরা কলা না বেচলে আফনেরা ফাইতাইন কই?
মো. নুরুল ইসলাম। ৭০ এর কাছাকাছি বয়স। বাড়ি নরসিংদী। রাজধানীর এয়ারপোর্টের কাছে প্রেমবাগান এলাকায় রাস্তার ধারে কলা বিক্রি করেন।
চাচা, প্রতিদিন কখন থেকে কলা বিক্রি করেন?
-বিকাল ৩টার দিকে আসি, রাইত ১১টা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বেচি।
তার আগে পর্যন্ত কী করেন?
-নরসিংদী থিকা আড়তে কলা আসে, ওইখানতে ভ্যানে কইরা কলা আনি, আমার নিজের ভ্যান আছে। কলা গুছগাছ করি, দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিই। এই কইরাই বিকাল হয়।
প্রতিদিন কী পরিমাণ কলা আনেন?
-১৫/২০ মণ।
দিনে কত টাকার কলা বিক্রি করেন?
-২/৩ হাজার টাকা।
লাভ থাকে কেমন?
-৬শ’-৭শ’ টাকা।
কলা তো দ্রুত নষ্ট হয়, দিনেরটা দিনে বিক্রি না হলে সেই কলা কী করেন?
-পরের দিন কম দামে, লসে বেইচ্যা দিই।
এখানে যে বসেন কোন ভাড়া দিতে হয়?
-হ, মাসে দুই হাজার টাকা।
কোন চাঁদা দিতে হয়?
-না।
কতদিন ধরে কলা বিক্রি করছেন?
-তিরিশ-পয়তিরিশ বছর অইবো। ঢাকা আসার আগে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেটে কলা বেচতাম।
কলা কেন বিক্রি করেন? নরসিংসদীর মানুষ, আর ওখানকার কলা বিখ্যাত তাই?
-এই কাজডা সহজ লাগে। আর আমি না করলে কেউ না কেউ তো করতোই। আমরা কলা না বেচলে আফনেরা ফাইতাইন কই (কোথায় পেতেন)?
কলা বিক্রির কাজটা বেশ আনন্দের সাথে করেন নুরুল ইসলাম। তিন ছেলে আর এক মেয়ে তার। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, স্ত্রী, ছেলে আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভালো আছেন। স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। মনে পড়ে শৈশবে শেখা রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার লাইন ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)