সূর্য নয়, মাথার ওপর যেনো জ্বলন্ত চুল্লি। বাতাস তো নয়, যেন ‘লু’ হাওয়া। গত কয়েকদিনের এই আবহাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরজীবন। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট পৌঁছেছে চরমে। তপ্ত হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। রোদে খাঁ-খাঁ করছে সড়ক জনপদ। বাইরে বের হলেই মনে হচ্ছে অগ্নিকুণ্ড। গরম বাতাস শরীরে বিঁধছে আগুনের হলকার মতো। দুঃসহ গরমে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরও হাঁসফাঁস অবস্থা। এই গরমে কোথাও শান্তি নেই। ঘরে-বাইরে সমান দুর্ভোগ ও অস্বস্তি।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু যা বর্ষাকে নিয়ে আসবে, সেটা তালছাড়া হয়ে গেছে সদ্য-বিদায়ী ঘূর্ণিঝড় ফণী’র প্রভাবে! কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টিতে যে গরম থেকে সাময়িক স্বস্তি মিলবে, সে রকম পরিস্থিতি এখন আবহাওয়া মণ্ডলে নেই। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণাবর্ত তো দূরের কথা, কোনো নিম্নচাপ অক্ষরেখা নেই। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের উপর উচ্চচাপ বলয় জলীয় বাষ্পকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে জেরবার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ক্রমাগত তাপ প্রবাহে আমরা যখন অস্থির, ঠিক তখন আবহাওয়া দফতর বলছে, দেশে মৃদু তাপ প্রবাহ চলছে! দেখো ঠ্যালা! এই যদি হয় ‘মৃদু’ তাহলে ‘চরম’ কী? আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু তাপ প্রবাহ বলে। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মাঝারি তাপদাহ বলা হয়। আর ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপদাহ হিসাবে বিবেচনা করা হয়! এই ‘সংজ্ঞা’র মারপ্যাঁচে আমরা তাপে সংজ্ঞাহীন হবার উপক্রম হলেও তাকে ‘তীব্র’ দাবদাহ বলা যাচ্ছে না!
প্রচণ্ড গরম, রোদের তীব্রতা, উপচে-পড়া মানুষ আর যানবাহনের ভিড়ে রাজধানী ঢাকা প্রায় বেসামাল। এই তীব্র গরম আর বেপরোয়া যানজট অসহনীয় করে তুলছে নগরীর জনজীবন। ঢাকায় গাছ কমেছে, জলাশয় কমেছে, কমেছে তাপরোধক আবাসন। আগে বিল্ডিং তৈরির সময় ইট-কাঠের যে পরিমাণ ব্যবহার হতো, তা ছিল তাপরোধক। এখন বিল্ডিং নির্মাণে কাচের ব্যবহার বহুল পরিমাণে বাড়ায় শহরের তাপমাত্রা গেছে আরো বেড়ে। নগরায়ণের সঙ্গে-সঙ্গে বেড়েছে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ব্যবহারও। সেটাও শেষ বিচারে নগরীর তাপমাত্রা বাড়াতেই সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, ঢাকাকে ঘিরে থাকা নদীগুলোকেও আমরা হত্যা করেছি দিনের পর দিন আমাদের লোভ আর লাভের কাছে। ঢাকার চারপাশ বেষ্টন করে থাকা নদীগুলোকে দখল আর দূষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও হয়ত ঢাকার সামগ্রিক আবহাওয়া কিছুটা বাসযোগ্য থাকত। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত লোভ আর নিয়ম না মানার সংস্কৃতি ঢাকাকে প্রায় বাসের অযোগ্য একটা নগরীতেই পরিণত করেছে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছরই গড় তাপমাত্রা কিছুটা করে বাড়ছে। এ বছর তো বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপটটা আরো স্পষ্টভাবে মালুম হচ্ছে। শীতেও জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েনি। বসন্তে দখিনা বাতাসের বদলে মাঝেমধ্যেই শুকনো গরম মিলেছে।
অতিরিক্ত গরম ও তাপ প্রবাহের কারণে আমরা কেবল হাঁসফাঁস করছি। সবার মুখে একটাই কথা: উফ্ফ্ কী গরম! জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম! মরে গেলাম! এত গরম বাপের জম্মে দেখিনি! আসলে গরম নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। যেমন নেই ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন নিয়ে কিছু করার! ‘উহা অনিবার্য, চলিতেই থাকিবে!’
জ্ঞানী-গুণীরা অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। তারা বলছেন, হে আদম সন্তানেরা, আপনারা বরং গরমকে এনজয় করতে শিখুন। অপ্রয়োজনীয় বৃষ্টিপ্রেমী পুতু-পুতু স্বভাবের ঘর্মভীরু পাবলিকের খাতায় নাম লেখাবেন না। ওদের সবকিছুতেই অভিযোগ করা স্বভাব। রক্তে দ্বিচারিতা, মেরুদণ্ডে কনট্রাডিকশন। এদিকে টাকার গরম দেখলে যুগপত্ লালা ও দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, রূপের গরম দেখলে বলবে, ‘ধ্যুত, কি আচরণ!’ অথচ মেরেকেটে মাস-তিনেকের এই যে গ্রীষ্ম, সে কিঞ্চিত গরম দেখালেই তেড়ে গাল পাড়বে। কেন রে বাবা? এই সিজনটাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর! গরমকালটা সোশালিস্টদের মতো। সাম্যবাদী। বউ থেকে এমপি, রিকশাওয়ালা থেকে মন্ত্রী, সবাইকে সমান জ্বালাবে। আই মিন তাপ দেবে আর কী। বর্ষার মতো ফিকল-মাইন্ডেড না, একদিকে জল জমলো তো আরেকদিকে ফকফকা। গ্রীষ্মের একেবারে সাধু-সন্ন্যাসীর মতো স্বভাব। মন-মুখ এক, নির্বিকার। সকাল নটাতেও ঝাঁ-ঝাঁ করছে, দুপুর দুটোয়ও ঠা-ঠা। এমনকি রাত দুটোতেও চনচন!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পোয়াবারো অবস্থা। গরম না থাকলে গরমের ছুটিটা কোত্থেকে তারা পেতেন? স্বয়ং কবি বলে গেছেন: ইফ সামার কাম্স, ক্যান সামার ভেকেশন বি ফার বিহাইন্ড? গরমকাল হলো তীর্থ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সেই তীর্থের কাক, আর বসে থাকেন চাতকপ্রায় সতৃষ্ণ, আমাদের ছুটি ছুটি আজ নেব লুটি!
কী বললেন? ইলেকট্রিক বিল বেশি আসে? ঘরের সব পাখা বনবন, তাতেও হয় না, দিনরাত এসি চালাতে হয়? বাঃ, আর ওদিকে যে গিজার চালাতে হয় না? কল খুলতেই উষ্ণ প্রস্রবণ কলকলাচ্ছে! অনেকেই শীতকালে গরম পানি ছাড়া গোসল করতে পারেন না। বছরের এই তিনটে মাস তো আর আপনাকে গজগজ করতে করতে পানি গরম করতে হয় না। দুপুরের দিকটায় সসপ্যানে পানি ধরে ডিম চুবিয়ে দেখুন, সেদ্ধ হবেই, গ্যারান্টি! আর নিজেই যদি হন এসি কোম্পানির মালিক, তা হলে আপনাকে কে পায়! দোকানের সামনে বিশাল লাইন।
এই সময়টা ‘চোখের সুখের’ও সময়! পথেঘাটে দেখবেন অনেকেই কেমন একটুখানি সাইজের পোশাক পরে ঘুরছে-ফিরছে! আর কোনো সিজনে বলতে পারবেন, স্মল ইজ বিউটিফুল? শীতকালটা বোরিং, আনখভুরু জাব্বাজোব্বা চাপিয়ে ঘোরে সবাই। বর্ষা এলো তো সঙ্গে জুড়ল ছাতা। যা-তা! এদের পাশে রাখুন এই ঋতুটাকে। দেখুন, গরমে কেমন মরমে-শরমে ওইটুকু কাপড় লেপটে আছে গায়ের নরমে! সাক্ষাৎ কোনো পোস্ট-মডার্ন পেন্টিং! বড় বড় শপিংমলগুলোতে লোক গিজগিজ, আপনি ভাবছেন ফ্রিতে এসি খাচ্ছে? আজ্ঞে না। সকলেই আড় চোখে সকলকে দেখে। চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে!
এই যেসব রোগব্যাধি হয়, সেগুলোও অনেক স্মার্ট! গরমে চিকুনগুনিয়া, ডায়রিয়া, পেটের অসুখ কিছু হয় বটে। কিন্তু সেগুলো আসলে গরমের রোগ নয়, বরং বলা যায়-বাঙালির চিরকালীন অসুখ। গরমের প্রকৃত ব্যামো হচ্ছে হিট-স্ট্রোক, সান-স্ট্রোক। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠাস করে পড়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। কী সুন্দর যন্ত্রণাহীন! হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নেই, হাজারো ক্লিনিক্যাল টেস্টে জেরবার হওয়া নেই, নানা ধরনের বড়-পাঁচন গেলা নেই, ভেন্টিলেশন নেই, কেমো নেই, যন্ত্রণায় ছটফটানো নেই, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খসিয়ে পরিবারসুদ্ধু সবার গুচ্ছের অভিশাপ কুড়ানো নেই। ঘেমো ঋতুও এমন ঘ্যামা মৃত্যু নিয়ে আসে!
আর বেঁচে থাকলেও, এই গরমই আপনার মুশকিল-আসান। পৃথিবীর যত্ত ‘উধো’-র যাবতীয় পিন্ডি চাপাতে পারেন এই ‘বুধো’-র ঘাড়ে। গার্লফ্রেন্ড অতিমাত্রায় ন্যাকামো করছে? গুছিয়ে গালাগাল দিন। পরে ম্যাসেঞ্জারে বললেই হলো, সরি, ইট ওয়াজ টু হট দ্যাট ডে (আঠাশটা ইমোটিকন জুড়তে ভুলবেন না)! বস-এর প্রতি অনেকদিনের রাগ এরিয়ার, ক্যারিয়ার পাচ্ছেন না? একটা ঝনঝনে গরম-দিনে স্যাটাস্যাট স্ট্রেট-ব্যাটে ঝেড়ে দিন- আপনার মতো তেলবাজ আর চতুর হতে পারলে আমিও অনেক উপরে উঠতে পারতাম! পরে মেইল করুন: দ্য ননসেন্স ওয়েদার টুক আ টোল অন মাই সেন্সেস…! সরি বস, হোপ, ইউ উইল ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যাণ্ড মি!
কোনো ‘হৃদয়ের রানি’কে প্রোপোজ করে প্রত্যাখ্যাত? পরেরদিন কোনো একটা উছিলায় হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে বলুন, উফ্ফ এই গরমে কাল কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আর তুমিও যেমন, ফান বোঝো না! বাগানের সব গাছের লিচু প্রকাশ্যে পেড়ে খাওয়া, পর্নো-সাইট বন্ধ করতে গিয়ে ফ্রিল্যান্স কাজের সাইট বন্ধ করে দেওয়া, আবার খোলা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, বউকে মাটিতে পুঁতে ফেলা, কাজের মেয়েকে মেরে ফেলা, মিথ্যে মামলা দিয়ে কাউকে ফাঁসানো-সবটাই আসলে এফেক্ট অব ব্লাডি সামার। এই গরমে মাথা ঠিক থাকে? জীবনের সব হোঁচট, হেঁচকি, আছাড়, ঠোঁক্কর, ছ্যাঁচরামি, নস্টামি, ঢোক, ঢেঁকুরের সঙ্গে মিশিয়ে নিন গরমকে। বেইজ্জতি থেকে বাঁচবেন!
আচ্ছা, মৌসুমি বায়ুর জন্য বঙ্গোপসাগর ঘেরাওয়ের একটি কর্মসূচি দেওয়া যায় না? বাংলাদেশে বিরোধী দল বলতে কোনো কিছুরই কি অস্তিত্ব থাকবে না? তারা কোনো ইস্যুতেই কোনো কর্মসূচি দেবে না? ভাসানী সাহেব না ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে ভারত কর্তৃক একতরফা গঙ্গার জল অপসারণের মাধ্যমে পদ্মা নদীকে জলশূন্য করে ফেলার বিরূদ্ধে ফারাক্কা অভিমুখে লং-মার্চ কর্মসূচি দিয়েছিলেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)