চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ধর্ষণ প্রতিরোধ: দরকার পুরুষের জন্য প্রশিক্ষণ

ধর্ষণ কি কোনো দুর্ঘটনা? বটে। যার জীবনে তা ঘটে, তার জন্য তো দুর্ঘটনাই। কিন্তু এটি কি কোনো বিচ্ছিন্ন কাণ্ড? না। বাংলাদেশে বলাৎকার একটি অনস্বীকার্য ও অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। একটি সমাজে যখন দিনে-রাতে প্রতিদিন, প্রতিমাসে, প্রতি বছরে, বছরের পর বছর ধরে শিশু, কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ় এবং এমনকি বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষিত হয় তখন তা ‘স্বাভাবিক প্রবণতা’। মানে, ঘটনা ‘অস্বাভাবিক’ ‘অমানবিক’ ও ‘অন্যায়’ হলেও এই ‘অস্বাভাবিকতা’ই‘স্বাভাবিক চরিত্র’ বলে বিবেচিত হতে বাধ্য।

এদেশে রাস্তায় পাগলিনী ধর্ষিত হয়। চাকুরীর সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অফিসে চাকুরীপ্রার্থী ধর্ষিত হয়। রেলওয়ে থানার ভেতর নারীকে আটকে রেখে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। বিদ্যালয়ে যাবার পথে মুখ আটকে পাটক্ষেতের ভেতর টেনে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। রাতের বেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। রাতের অন্ধকারে ঘরের বেড়া কেটে ধর্ষণ করা হয়। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। ফিরিস্তির শেষ নেই।

২০২০ সালের প্রথম দশ দিনে শুধু ঢাকা শহরেই ৬জন ধর্ষিত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি হয়েছে বলে সংবাদে জানিয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তর।

খেয়াল করুন,শুধু ঢাকাতেই ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ জন। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না, এই ৬ জনের বাইরে আনরিপোর্টেট বা অপ্রকাশিত আরো অন্তত কয়েকটি ঘটনা রয়ে গেছে? তাহলে চলুন, হাইপোথেটিকেলি ধরে নিই, বছরের প্রথম ১০ দিনে ঢাকায় ধর্ষিত হয়েছে অন্তত ১০জন। আর ঢাকার বাইরে ৬৩ জেলায় যদি আরো ১০ জন করে ধরা হয়, তাহলে মোট সংখ্যাটা দাঁড়াবে বাইরে ৬৪০ জন। অর্থাৎ এটি হলো বছরের প্রথম ১০ দিনের পরিসংখ্যান। মাসের বাকি ২০ দিন তো এখনো বাকি। আর বছরের বাকি ১১ মাসের হিসেব করে আমিও নিজেও অসুস্থ হয়ে যেতে চাই না।

৬৪ জেলার মোট ৪৯২টি উপজেলায় গড়ে ১০টি ধর্ষণের ঘটনা ধরার দরকার নেই। প্রতি জেলায় ২টি করে ধরুণ। তাতেও ১২৮টি ঘটনা বছরের এই প্রথম দশ দিনেই ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে বলে আশঙ্কা করা অমূলক হবে না। কিন্তু কয়টা ঘটনার কথা আপনি জানেন? নাকি আপনি বিশ্বাস করেন যে, পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া ঘটনাগুলোর বাইরে বাংলাদেশে আর কোনো বলাৎকারের ঘটনাই ঘটেনি?

সব ধর্ষণ কি কুর্মিটোলার মতন রাস্তার পাশে হয়? সব ধর্ষণে কি ভাটাড়ার ঘটনার মতন ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নগ্ন ও রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়? অনেক ঘটনাই আছে, যা চুপচাপ ঘটে। চুপচাপ ঘটা এসব ঘটনায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি এবং তার পরিবার পাঁচ কানও করেন না। করতে ভয় পান। ভয় পান সামাজিক কারণে। ভয় পান আইনি মারপ্যাঁচ নিয়ে শঙ্কা-ভয় থাকার কারণে। ভয় পান থানা-পুলিশের প্রতি ভীতি-জাগানিয়া সমীহের কারণে। এর বাইরে, ঘরে-ঘরে থাকা গৃহকর্মীদের কথা ভাবুন। কত গৃহকর্মী নিয়মিতভাবে গৃহকর্তার হাতে ধর্ষিত হন? সেই পরিসংখ্যানআছে কারো কাছে? নাকি প্রকাশ পায় না বলে তারা ধর্ষিত হয় না?

আপনি হয়তো বলতে পারেন, হাইপোথেটিকেলি যে পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরলাম তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথবা বলতে পারেন, এই চিত্র সত্য হলে তা ‘ভয়ংর’।সত্যি বলতে আমি চাই, আপনি ভয় পান। আমি চাই, আপনি আঁৎকে ওঠুন। আমি চাই, আপনি লা-জওয়াব হয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবুন। কেননা, চোখ বন্ধ করে থাকলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। আর সেই প্রলয়েরই কিছুটা প্রমাণ দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা ধর্ষণের খবরগুলো। বাস্তবে যত ঘটনা ঘটে তার অর্ধেকও রিপোর্টেট হয় না বলে আমি দৃঢ়ভাবে ধারণা করি এবংএই ধারণা অমূলক নয়।

নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারীকে তারা মোটাদাগে যৌন বস্তু এবং মাংসপিণ্ড ভাবে। ফলে, শিশু, তরুণী, প্রৌঢ়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল বয়স ও শ্রেণিভেদে এই বাস্তবতা বিরাজমান। ধর্ষকেরা সবাই শ্রেণিগতভাবে মজনুর শ্রেণীভুক্ত নয়। ধর্ষকেরা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমলা শ্রেণিভুক্তও হয়ে থাকেন।

একে তো এদেশে নারীর প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নেতিবাচক। তার উপরে, আইনের প্রতি মানুষের জন্ম নিয়েছে অনাস্থা। মজনুর ঘটনাই এই অনাস্থার অন্যতম প্রমাণ। ধর্ষণের শিকার নারী যেখানে ধর্ষককে চিহ্নিত করেছেন, সেখানেও সমাজের বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অনাস্থার কথা জোরেসোরেই জানান দিচ্ছেন। বহু মানুষ মনে করছেন, মজনু একটি ‘জজ মিয়া নাটক’। মানুষের এই ধারণা ঠিক না হলেও এই ধারণা জন্মাবার পেছনের বাস্তবতাটিকে অস্বীকারের উপায় কী?

ধর্ষণের শিকার হলে বা কোনো বড় রকমের হত্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে এই দেশে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়। প্রতিবাদ করতে হয়। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বা ‘বিচার চাই’, ‘বিচার চাই’ বলে রাজপথ প্রকম্পিত করতে হয়। এই ঘটনাগুলোও সাক্ষ্য দেয় যে, অন্যায়ের ঘটনায় সমাজে সুবিচার না হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই, রাস্তায় নেমে মিছিল করে, স্লোগান দিয়ে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমকে তরান্বিত করতে হয়। এই বিচার-তরান্বিত করার প্রক্রিয়া স্বয়ং স্বাক্ষ্য দেয় যে, স্বাভাবিক গতিতে এই দেশে সুবিচার পাওয়া সোনার হরিণ। যার দেখা, সকল ভুক্তভোগী পায় না।

এই দশা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে আপনি কি মেয়েদের হাতে-হাতে ছুরি, চাক্কু, ক্ষুর বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দেবেন? তাদেরকে বিনামূল্যে অস্ত্র সরবরাহ করবেন? আক্রান্ত হওয়া মাত্রই আক্রান্তকারীকে মেরে ফেলার অনুমতি ও বৈধতা দেবেন? যদি তা না করেন, তাহলে কি সব নারীকে ‘সাবধানে’ ‘দেখে-শুনে’ ‘সতর্ক’ হয়ে পথ চলতে বলবেন? সান্ধ্য আইন জারি না থাকলেও, ‘নিরাপত্তা’র কথা চিন্তা করে সন্ধ্যার পরে তাকে বাইরে যেতে মানা করবেন? বাইরে গেলেও একা বাইরে যেনো না যায়, সেই বিষয়ে সতর্ক করবেন?

এই দুই পন্থার কোনোটাই স্বাভাবিক নয়। এই দুই পন্থার প্রতিটিই রাষ্ট্রের ব্যার্থতার বিজ্ঞাপন। আইনের শাসন যদি থাকে এবং তার সুফল যদি সকল নাগরিক সমভাবে পায় তাহলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো নাগরিকের ‘ভীত’ ‘সন্ত্রস্ত’ হবার কথা নয়। অথবা, ঘর থেকে বের হতে গেলেই আগে আত্মরক্ষার কথা ভাবার কথা নয়। অথবা দৈবাৎ কোনো দুর্ঘটনা বা অন্যায় ঘটে গেলে সুবিচার পাবার জন্য স্লোগানে-স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করার কথা নয়।

ধর্ষকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য নারীর হাতে অস্ত্র তুলে দেবার দরকার নেই। ছেলে শিশুটি যেনো ধর্ষক মানসিকতার পুরুষে পরিণত না হয়, সেই জন্য তাকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনুন। ‘পুরুষালি আচরণ’ রপ্ত করার নামে, পুরুষ ব্যক্তিটি যেনো ‘দানব’ ও ‘অপরাধী’তে পরিণত না হয়, তাকে সেই বিষয়ে সতর্ক করুন। পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য কাম্প্যেইনের ব্যবস্থাই প্রধানত দরকার। সেই ক্যাম্পেইনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও স্বল্পস্থায়ী ব্যবস্থা রাখতে হবে। ক্যম্পেইন কতখানি সফল বা বিফল হচ্ছে সেই বিষয়েও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।

নারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার আগে পুরুষের জন্য প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করা জরুরী। যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীকে ‘ভোগের বস্তু’, ‘মাংস পিণ্ড’ হিসেবে ভাবার উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেই সমাজের মগজের মধ্যে এন্টিডট বা প্রতিষেধক দিতে হবে। নইলে, এই ধর্ষণ মহামারীর হাত থেকে মুক্তি নেই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)