চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দ্বিতীয় আর কে আছেন তোয়াব খানের মতো

প্রতিবার একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরষ্কারের সময় মন খারাপ লাগতো। গুরুত্বপূর্ণ, অগুরুত্বপূর্ণ অনেককে একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সাংবাদিকতায় তোয়াব খানের নামটি না দেখে আক্ষেপ বাড়তো প্রতিবার। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে যত ব্যক্তি একুশে পদক অথবা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তাদের সিংহভাগ পেশাদারিত্বে-মননে-মেধায় তোয়াব খানের কাছে নস্যি। এরমাঝে এমন কিছু দলবাজ, ধান্ধাবাজ, বিতর্কিত ব্যক্তিকেও এসব পদক-পুরস্কার দেয়া হয়েছে! একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০১ সাল অবধি পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতাসীন ছিল। ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে এর মাঝে পার করেছে টানা ক্ষমতার সাতবছর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই মহীরুহ সাংবাদিককে একুশে পদকের জন্যে মনোনীত করতে তাদের এতবছর সময় লাগলো কেনো? তোয়াব খানের যোগ্যতা জানার মতো লোকের অভাব? এই লোকগুলো কারা যারা জাতীয় সর্বোচ্চ পদক-পুরস্কারের তালিকাটি করেন? তাদের যোগ্যতা কী? প্রশ্নটা এখানেও রেখে গেলাম। 

আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ তোয়াব খান। মৌলবাদের বিরুদ্ধে, নারী-আদিবাসীদের ক্ষমতায়নসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আধুনিক-প্রগতিশীল যে চিন্তা-চেতনা বোঝায় এর সব তিনি ধারণ-লালন করেন। আমাদের মিডিয়ার পণ্ডিতমন্য অনেকের কিন্তু পড়াশোনার সমস্যা-সীমাবদ্ধতা আছে। ফাঁকা কলসি বাজে বেশি। প্রথাগত ডিগ্রী তোয়াব খানের নেই। কিন্তু তার যে পড়াশোনা আছে এবং এখনো প্রতিদিন পড়েন, এমন পড়ুয়া দ্বিতীয় কে আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। নিজে সারা সময় ডুবে থাকেন কাজের মধ্যে। কাজের লোক চিনতে পারেন। কাজের লোককে খুঁজে নিয়ে কাজ দেন। তার থেকে কাজ আদায় করতে জানেন। এরজন্যে যতদিন জনকন্ঠে তোয়াব খানের কর্তৃ্ত্ব ছিল ততদিন কত যে কাজের মানুষজন ছিল এ পত্রিকায়। জনকন্ঠ তখন ছিল দেশের এক নম্বর পত্রিকা। 

ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে হাতেকলমের শিক্ষক-পথিকৃৎ অনেকে আছেন। কিন্তু তোয়াব খানের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের অর্জন-অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান-দৈনিক বাংলা-জনকন্ঠ এই চার অধ্যায়ে ভাগ করা যাবে তার সৃষ্টি। এরমাঝে জনকন্ঠের মাধ্যমে তিনি দেশের সংবাদপত্রে এমন কিছু চালু করেছেন, যা বাংলাদেশে প্রথম। একসঙ্গে দেশে পাঁচটি শহর থেকে পত্রিকা প্রকাশ, খুব সকালে বাংলাদেশের সব জায়গায় পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেয়া, ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা প্রকাশ, প্রতিদিন রিপোর্টিং মিটিং, পত্রিকার মেকাপ-গেটাপ সবকিছুর আমূল সংস্কার, এসব তার মাধ্যমেই হয়েছে। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সবার উপরে তুলে ধরে একটা পত্রিকা যে সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় হতে পারে তা তোয়াব খান করে দেখিয়েছেন। সেই পত্রিকা সারাদেশে পৌঁছেছে সবার আগে। আজ দেশে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, এর পটভূমিও তৈরি করে দিয়েছে জনকন্ঠের সিরিজ প্রতিবেদন ‘সেই রাজাকার’! এই পত্রিকার পাঠকরা জোটবেঁধে ভোট দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রাজাকারবান্ধব খালেদা জিয়ার সরকারের পতন ঘটান। একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। সেই ক্ষমতায় ফেরা আওয়ামী লীগ জনকন্ঠের ভূমিকা-অবদান মনে না রাখলেও ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ফিরে তা ঠিকই মনে রেখেছেন! বিএনপি-জামায়াতের সরকার জনকন্ঠকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়! আজ দেশের মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার সুশীলদের একজনও কিন্তু তখন জনকন্ঠের পাশে-পক্ষে দাঁড়াননি! বরঞ্চ দেশের এক নম্বর পত্রিকাটিকে শুকিয়ে মারতে যার যার মতো করে ভূমিকা রেখেছেন!  

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার তিন দিকপাল আহমেদ নূরে আলম, মোনাজাতউদ্দিন, শামছুর রহমানসহ অনেকে তাদের জীবনের সেরা অনেক কাজ জনকন্ঠে করেছেন তোয়াব খানের নেতৃ্ত্বের কারণে। তার সব সময় তাগিদ থাকতো পত্রিকায় এমন কিছু রাখা যা অন্য পত্রিকায় নেই। একবার সিদ্ধান্ত নিলেন সারা বছর জনকন্ঠের কোনো একজন সাংবাদিক বিদেশে থাকবেন। পত্রিকায় আলাদা একটি স্বাদ রাখার জন্যে ছিল সেই উদ্যোগ। সে কারণে সিডনি অলিম্পিকে আরিফুর রহমান শিবলির অথবা চীনের সঙ্গে হংকং’এর একীভূত হওয়ার ঐতিহাসিক মূহুর্তে আমান-উদ-দৌলার বিশেষ কিছু রিপোর্ট জনকন্ঠকে তার জাত চিনিয়েছে। জনকন্ঠে যতদিন তার কর্তৃ্ত্ব ছিল এ পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে ভাবতে হয়নি। জনকন্ঠের হয়ে কাজ করতে করতে প্রাণ হারান মোনাজাতউদ্দিন, শামছুর রহমান। তোয়াব খানের অভিভাবকত্বের কারণে তখন জনকন্ঠ পরিবার দুটির পাশে দাঁড়ায়। বীমা-প্রভিডেন্ট ফান্ডের এককালীন টাকার বাইরে পরিবার দুটিকে দীর্ঘদিন অফিস থেকে বেতন-ভাতা দিয়ে যাওয়া হয়! বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন পত্রিকা অফিসে তা আজো ভাবা যায়? এমন আরও অনেক কিছু সম্ভব হয়েছিল তোয়াব খানের অভিভাবকত্বের কারণে। এমন আরও অনেককিছু আছে। একদিন তাকে নিয়ে গবেষণা হবে। একবার কলকাতা বইমেলায় তাকে অতিথি করে নেয়া হয়। সেখানে তিনি যে বক্তব্যটি রেখেছিলেন তা আধুনিক সংবাদপত্র আর চলতি সময়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক নানাকিছুর দর্পণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। 

এখানে জনকন্ঠ থেকে নেয়া তার জীবনকথার কিছু তথ্যঃ তোয়াব খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে। পিতা আবদুল ওহাব খান, মা মোসাম্মৎ জোবেদা খানম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাদের বাড়িটি ছিল স্বদেশী আন্দোলনের একটি কেন্দ্রের মতো। পরিবারের অনেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ। সাতক্ষীরার শতাব্দী প্রাচীন প্রাণনাথ হাইস্কুলে (পিএন) তার শিক্ষা জীবনের শুরু। এই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর পড়াশোনা করেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় সমকালীন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করতেন। তবে ১৯৫৫ সালে প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদ-এ সাব-এডিটর হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পত্রিকাটি ছিল তৎকালীন বামপন্থী নেতাকর্মীদের মত প্রকাশের একটি অভয়স্থল। মণি সিংহ, খোকা রায়, নেপাল নাগ, বারীন দত্ত, রণেশ দাস গুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ আলী এদের মতো নেতাদের সান্নিধ্য তোয়াব খানের জীবন ও চিন্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, এভাবেই অজান্তে হয়ে গেছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে গেছে জীবনের গতিপথও। এভাবেই অনেকটা ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া। তাতে ক্রমেই শিকেয় উঠেছে পড়াশোনা।

১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালেই তিনি তৎকালীন ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় যোগ দেন চীফ সাব-এডিটর হিসেবে। ১৯৬৫ সালে তিনি দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার লেখা ও পাঠ করা ‘পিন্ডির প্রলাপ’ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি বাঙালীকে প্রেরণা যোগাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যোগ দেন দৈনিক বাংলায়-(অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তান) ১৯৭২ সালে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকাটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রাষ্ট্রপতি সাহবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিব ছিলেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও মহাপরিচালক ছিলেন ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত।

১৯৯২ সালে দৈনিক বাংলায় আবারও সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ যেন ছিল তার নিজের ঘরে ফেরা। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মৌলিক নীতির প্রশ্নে আপোষ করতে না পারায় তৎকালীন সরকার তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করে। পরে যোগ দেন দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক পদে। সেই থেকে আজ অবধি তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত। এই পত্রিকার প্রতিটি পাতায় তার উদার পেশাদারী আধুনিক মনোভাবের বহির্প্রকাশ।

১৯৬২ সালে তোয়াব খান বিয়ে করেন। স্ত্রী হাজেরা খান। ২ কন্যার জনক তিনি। এর মধ্যে এক কন্যা এষা খান মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। অপর কন্যা তানিয়া খান আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে থাকেন। পেশায় শিক্ষক। তোয়াব খান বাংলা একাডেমি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য লাভ করেছেন বহু সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য কলাম সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়া-এরশাদ-বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে অনেক স্মৃতি আছে তোয়াব ভাইয়ের। সর্বশেষ তার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপে তিনি কথা দিয়েছিলেন তিনি আত্মজীবনী লিখবেন। লিখেছেন কী? যারা সামনে আছেন তারা তাকে তাগাদায় রাখবেন আশা করছি। নতুবা আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হবো। সুস্থ থাকুন প্রিয় তোয়াব ভাই। বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারিকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)