ডেসমন্ড সাহেবের পূর্বসূরীদের একজনকে ইতিহাস আজো নিশ্চয়ই ভুলেনি। চারটি চিল, অথচ পা হলো দু’টি। ছোট্টবেলায় অমন ধাঁধার ভেতর মজা খুঁজে পেতাম ঢের। সেই চার্চিল, সেই উইনস্টন, গর্বভরে বলতেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায় না। তখন ছিল উপনিবেশ গড়ার যুগ। ফরাসী, ওলন্দাজ, পর্তুগীজ, ইংরেজ গোটা দুনিয়াটা ভাগাভাগি করে শাসন ও শোষণ চালাতো। তখন এই ‘আকামে’ শিরোমনি ছিলেন দুই ঠ্যাংওয়ালা চার্চিল মিয়ারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে চার্চিল মিয়াও গেছেন, সঙ্গে গেছে ইংরেজ বাহাদুরীও। একে একে একসঙ্গে খসে পড়েছে এক এক উপনিবেশ। দুনিয়ার ইংরেজ মাতব্বররা ঝুরা মুরা হয়ে গেল পর পর। বিশাল ভারতবর্ষ থেকে বুড়ো আঙ্গুল উপহার পেল এরা ১৯৪৭ সনে। এসব দেশ ছাড়ার সময় ‘বৃটিশ প্যাঁচ’-এর খেলা যতোই খেলুক তারা, পশ্চাদপসরণ করতে হলো তাদের বেশরমভাবে।
প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে একসূত্রে গাঁথার জন্য তারা একটি নয়নমনোহর নাম খুঁজে বের করলো : ‘কমনওলেয়থ’। অর্থাৎ পূর্বতন উপনিবেশের সব দেশের সম্পদ মিলিয়ে হবে সাধারণ সম্পদ মানে ‘কমনওয়েলথ’। মানবসভ্যতায় এহেন ধোঁকাবাজির শব্দ খুব কমই আছে।
‘কমনওয়েলথ’ শিরোনামে খেলাধূলা, বৃত্তি, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি ইত্যকার বহু কিছু আছে। কিন্তু আসল জিনিসটিই নাই। অর্থাৎ বৃটিশদের তহবিলদাবির ‘গরম’ সব ঠান্ডা মেরে গিয়েছে। এখনও ভিতরে ভিতরে হুংকার আর গর্জন মারে উহারা। তবে লোকে হাসে। পৃথিবী হাসে। ‘গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল’ বাগধারাটিকে সার্থক করে ওরা বেঁচে বর্তে আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ কায়দায় সে কায়দায় চলছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’। আর ঠান্ডা যুদ্ধের মহাগরম নেতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো উপনিবেশ চলছেনা। তাই চলছে নবকায়দায় উপনিবেশ। মার্কিনী মাতব্বর বুশের একান্ত পোষা প্রাণীর মতো ব্লেয়ার সাহেবরা যেমন বেহায়াগিরি করে দুনিয়ায় প্রাসঙ্গিক থাকার ‘ক্যারিকেচাল’ করেছে ইরাক যুদ্ধের অজুহাত আর পরিবেশ সৃষ্টিতে, তা ভবিষ্যতের বৃটিশ নাগরিকদের জন্য পরম লজ্জার চিহ্ন হয়ে থাকবে বহুকাল।
সেই বৃটিশ দেশের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সিলমারা একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। ওটার পূর্ণ, প্রতি ও উপ-পদ, আঞ্চলিক পদ রয়েছে। ওদেশে সরকার বদলায়, পদ বদলায়না, মুখ বদলায়। একেক বার একেকজন দেবদূত কিংবা দেবীদূত ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন’ তথা সাহায্য-টাহায্য মার্কা সবিশেষ দানশীল বদান্যতা বদন নিয়ে পৃথিবীর এদেশ ওদেশ বাংলাদেশে হাজির হন। আর সফরের সময় অযাচিত অভদ্র উপদেশ বিতরণ করেন।
সেইসব উপদেশের নির্যাস নিয়ে আমাদের এখানকার কতিপয় মিডিয়া ক্ষিপ্ত ও সুশীল সুযোগ সুবিধাওয়ালারা একই সঙ্গে লাফিয়ে পড়েন। অবশ্য এসব সফরের শুরুর দিকে বিশেষত: সাঁঝের মায়ায় সুধা সুরুৎ আপ্যায়ন অনুষ্ঠানে এহেন দেব কিংবা দেবীদূতরা কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে অভিমত সংগ্রহ করে থাকেন ঐসব মিডিয়া-সুশীল পুচুং পাচুংদের কাছ থেকে।
এবার এসেছেন ডেসমন্ড মিয়া। বৃটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তিনি। দেবদূত সফরের শুরুতেই এক দারুণ মহাবাণী দিলেন: ‘বিচার বহির্ভূত হত্যা মানা যায়না।’তা ওটা যদি ডেসমন্ড মিয়ারাও মানেন, পৃথিবীতে বিবেক বুদ্ধি প্রকৃত সুশীলতা-বিবেচনা যাদের আছে, এমন একজনও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কখনো ভুলেও মানতে পারেননা। নইলে পৃথিবীতে ‘বিচার ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার বিন্দুমাত্র যৌক্তিকতা থাকতে পারেনা।
‘বিচার হির্ভূত হত্যাকান্ড’ পৃথিবীর অনেকদেশেই সরকারগুলোর একটি ‘সহজ’ ব্যবস্থা, যা দিয়ে তারা অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃংখলা পরিস্থিতিকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার সস্তা এবং টোটকা দাওয়াই হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। এই ব্যবস্থা আখেরে ফল দেয় না, বরং উল্টো বড় বিপদ হয়ে দেখা দেয়।
এদেশে নব্বইয়ের পর ‘বর্তমান গণতান্ত্রিক পর্বে’ এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু হয় একই গল্প, একই চিত্রনাট্য দিয়ে। শুধু স্থান-কাল, পাত্রের নাম বদলেছে, কিন্তু সেই একই কাহিনী। যারা এ কাহিনী বিতরণ করে, যারা এ কাহিনী শ্রবণ করে, কেউ ওটাকে মূল্য দেয় না। এটা সবাই বোঝে।
পূর্বতন বিএনপি গণতান্ত্রিক আমলে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলে দ্রুত অ্যাকশন ফোর্স যখন এখানে সেখানে একই গল্পের নানা দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকলো, তখন দেশী বিদেশী মানবাধিকার পয়েন্টগুলো থেকে আপত্তি আর প্রতিবাদ তোলা হলো। সেসময় দেখেছি পাশ্চাত্যে দীর্ঘকাল অবস্থান করা স্বদেশবাদী তুখোড় চৌকশ শফিক রেহমানরা মানবাধিকারওয়ালাদের ‘ চৌদ্দগুষ্ঠি’ উদ্ধার করে দিলো নানারূপ প্রচারে, পোস্টারে। অবশ্য সাধারণ মানুষ যারা, দীর্ঘসূত্রিতা এবং দুর্নীতির দাপটে যারা বিচারের বাণীকে নিভৃতে এবং প্রকাশ্যে কাঁদতেই দেখে আসছে চিরটা কাল, তারা কিন্তু এহেন ‘ধুড়–ম ধাড়–ম’ বিচারবহির্ভূত পন্থায় সামাজিক দুর্বৃত্তদের হত্যাকান্ডে বেশ খুশি হয়।
এখন ক্ষমতাসীন ‘বর্তমান’ সরকারগুলো সাময়িক সাফল্যে তৃপ্তির মুখব্যাদান করে আরাম পায়। এই আরাম নিয়েছে গণতান্ত্রিক পর্বের সবগুলো সরকার। এমনকি জরুরি অবস্থার সরকারও।
সর্বশেষ ‘বর্তমান’ সরকারটিকে উৎখাত-এর জন্য লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে, সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে ব্যাপক হিংসার নকশা তৈরি হয়েছে। সে অনুযায়ী দুই দুইবার ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে ‘বর্তমান’ সরকারের ওপর প্রতিপক্ষওয়ালা সর্বষড়যন্ত্র, সর্বশক্তি সহকারে সহিংসার, নৃশংস এবং দানবিক আক্রমণ চালিয়েছে সর্বত্র। এই আজমন্টের বিশাল জোটে পাশ্চাত্যের, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দূতাবাস, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দাচক্রসহ বিশেষ বিশেষ শক্তি টাকা-পয়সা-প্রযুক্তি সহকারে শামিল হয়েছিলো। আর ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার এসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই অবহিত থাকায় পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, অপহরণ প্রভৃতি নানা কৌশলে প্রতিপক্ষের আক্রমণের চোখা চোখি পয়েন্টগুলোকে ভোঁতা করে দিতে চেয়েছে।
সে অর্থে এদেশে কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার-এর বারটা বেজে গেছে। দেশে একরকম যুদ্ধাবস্থা প্রায় একাত্তরের অনুরূপ দৃশ্যপটেই চলছে। একদিকে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের জোট। বিপরীতে ওদের একাত্তর সময়কালীন প্রতিপক্ষ। তবে কায়দা করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ কেউ ওদিকে কৌশলের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জাগতিক নানা নগদপ্রাপ্তির মহামাহাত্ম্যে। এখন গণতন্ত্রের প্রতি ‘মুক্তিযুদ্ধপন্থী’ অনেকের এতেই মায়া যে, প্রয়োজনে ‘যুদ্ধাপরাধীরা’ ক্ষমতায় আসুক, সেটাই সই, তবুও ‘গণতন্ত্র জিন্দাবাদ’। প্রয়োজনে লাশ ফেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের ‘সুমহান’ স্বার্থে!
দুই দুই বারের প্রবল হিংসার-নৃশংস আক্রমণের পরও ক্ষমতাসীনদের হটাতে দৃশ্যত: ব্যর্থ হয়ে আপাতত: পিছিয়ে পড়েছে ক্ষমতাবহির্ভূত পক্ষ। তাদের বড় বড় নেতা ‘গুম’হয়ে গেছে, তবু যেন তাদের এখন আর ‘ঘুম’ ভাঙ্গে না। শোনা যায় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ‘লাইন’ মারার গোপন প্রতিযোগিতায় এখন গড়ে উঠছে নানা এপিসোড। কেউ অন্যায়ের ‘প্রাসাদ’ বাঁচাতে, কেউ মানবাধিকার ‘বউ’ এর লীজ সমূহ বাঁচাতে, নানাভাবে মেরুদন্ড শিথিল করে ফেলছে।
দেশের সবখানে প্রায় এই প্রধান বিরোধীপক্ষের লেজ এবং তেজ দৃশ্যত। যুদ্ধাপরাধীরাও মাঠে নিশ্চুপ। শুধু একদল ‘আনসারুল্লাহ’ হঠাৎ হঠাৎ বীভৎস আক্রমণে করে হয়ে ওঠে বিশ্ব শিরোনাম। কেউ কেউ বলে ওটা যুদ্ধাপরাধী জোটেরই এক নতুন ফ্রন্ট মাত্র।
কিন্তু সারা দেশে তৃণমূলে কার্যত: সরকারদলীয় একপক্ষেরই একক কর্তৃত্ব, দাপট, দুরাচার আর দুর্বৃত্তপনা। ওটা দিন দিন এমন পর্যায়ে গেছে যে মাতৃগর্ভেও শিশুর নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে সরকার এবং প্রশাসনও কেমন বিদিশা। দিশাহারা।
সেই দিশা ফিরিয়ে আনতেই বুঝি দেশের কয়েকটি নাজুক প্রান্তে অতিসম্প্রতি শুরু হয়েছে বিচারবহির্ভূত অ্যাকশন। গল্প, চিত্রনাট্য, প্রেস ব্রিফিং সব এক। এবার স্থান কাল পাত্রে খোদ ক্ষমতাসীন কেন্দ্র। অনেকটা আত্মঘাতী ধরণের। ঢাকার জিগাতলায় ছাত্রলীগ নেতা আরজুর মৃত্যুতে ক্ষেপে উঠেছে খোদ আওয়ামী লীগ, শেখ পরিবারের তরুণ সদস্য শেখ মণি তনয় ব্যরিস্টার তাপস সহ অনেকে। সারা দেশে ক্ষমতাসীন তা বড় তাগদওয়ালা ক্ষিপ্ত। কিন্তু কী আশ্চর্য, সারা দেশের সাধারণ মানুষ মনে মনে খুশি এই মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রমে। একজন মন্ত্রীতো বলেই ফেলেছেন, ‘এবার অ্যাকশন শুরু’, ঐ মন্ত্রীর উপর এবার খোদ সংগঠনের হাজার জন ক্ষেপে ভোম। এদিকে মানবাধিকারওয়ালারা নবশক্তিতে বলে উঠছেন, কী, এতোকাল কী ভুল বলেছিলাম, বুঝুন ভাই ও বোনেরা।
এমনি পটভূমিতে এদেশে এলেন বৃটিশ দেবদূত ডেসমন্ড ভ্রাতা। এসেই তিনি বললেন অমোঘ বাণী: ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা মানা যায় না।’ সত্যিইতো। এক্ষেত্রে দু’টি কথা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। তা বিচারে দন্ডিত কয়েকজন অপরাধী বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। একজনতো মার্কিন মুল্লুকে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছে। বিচারের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিকে পাশ্চাত্যের আশ্রয়ে বিচারের বহির্ভূত রাখার এই অপকান্ড সম্পর্কে মার্কিনী পোষাপ্রাণীদের প্রতীক ডেসমন্ড ভায়া কী বলবেন!
দুই. এ পর্যন্ত পৃথিবীতে আপনারা পাশ্চাতওয়ালারা ড্রোন ছুঁড়ে কতো নিরীহ ব্যক্তিদের হত্যা করেছেন? আর বাংলাদেশে এসে ছুঁড়েছেন বুঝি ড্রোন যোগে মহান দেবদূত বাণী! ভন্ডামী-ভনিতা-ভোগলামি তথা ভ-ভ-ভো আর কতোকাল হে ডেসমন্ড!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)