দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিরুদ্ধে ‘নখদন্তহীন বাঘ’ হয়ে থাকার অভিযোগ বহুদিনের। তবে তারা যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একেবারেই অসফল, তা নয়। দুর্নীতিবাজদের দমনে প্রতিষ্ঠানটি অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার সাক্ষর রেখেছে। যদিও সম্প্রতি ঘটেছে অভূতপূর্ব এক কাণ্ড। গত বুধবার কর্মচারী চাকরী বিধিমালা ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধি উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান মো. মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ প্রতিষ্ঠানটির আলোচিত উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছেন।
এই ঘটনার পর দুদকের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে প্রধান কার্যালয়ের সামনে দুদক কর্মীদের অংশগ্রহণে মানববন্ধনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। যা এক দিকে যেমন অভূতপূর্ব, আরেক দিকে উদ্বেগজনকও বটে। ওই মানববন্ধনে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তারা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও দাবি করেন। সেখানে দুদক কর্মকর্তারা বলেন, শরীফ উদ্দীন সবশেষ পটুয়াখালীতে কর্মরত ছিলেন। এর আগে চট্টগ্রামে দায়িত্ব ছিল তার। দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে শরীফ তখন ৫২টি মামলা করেন বিভিন্ন ঘটনায়। বিশেষ করে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদঘাটন ও অনুসন্ধান করেছেন তিনি। এর পরপরই তাকে বদলি করে দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে। দুদক কর্মকর্তাদের দাবি, এমন ঘটনা দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতার সমার্থক।
দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিতে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা দূর করার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এক বিবৃতিতে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় দক্ষতা ও সাহসের সাথে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মামলা পরিচালনায় মূল ভূমিকায় ছিলেন। এসব অভিযান ও মামলায় সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মধ্যে যাদের বিরাগভাজন হয়েছেন এই কর্মকর্তা, তাদের চাপেই কি তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করার পর চাকরিচ্যুত করা হয়েছে? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে।
টিআইবি মনে করছে, দুদকের চাকরিবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মীকে অপসারণের এখতিয়ার তার হাতে থাকতেই পারে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো, তা জানার অধিকারও জনগণের রয়েছে।
আবার চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের কথায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, পেট্রোবাংলার একটি প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পেট্রোবাংলার ডাইরেক্টর (প্লানিং) আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়ায় গত ৩০ জানুয়ারি (আইয়ুব খান) বাসায় গিয়ে তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি দেন।
এই ঘটনার ১৬ দিনের মাথায় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় আমরা শঙ্কিত। কেননা দুদকের সৎ ও সাহসী কর্মকর্তারা কাজ করতে গিয়ে এভাবে চাকরিচ্যুত হলে প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। তাতে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে, যা কারোরই কাম্য নয়। কারণ দেশ যে গতিতে এগিয়ে চলছে তা অব্যাহত রাখতে দুদককে আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, যেকোন বিষয়ে দুদকের স্বচ্ছতা দুর্নীতি দমনে নিষ্ঠার সাথে কাজ করা কর্মকর্তাদের উদ্যম ফিরিয়ে আনবে। দুদক নেতৃত্ব এ বিষয়ে নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন বলেই আমাদের আশা। প্রতিষ্ঠানটি যেন দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচে পরিণত না হয়ে তাদের যমদূত হয়- সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।