ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় শুরু থেকেই সেখানকার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া কিংবা ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টায় জড়িত থাকার কথা উঠে এসেছিল। সেই ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তে তার অপেশাদারিত্বের প্রমাণ হয়। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল।
পিবিআই’র তদন্তে বলা হয়েছে: ‘মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় (২৬, ২৯ ও ৩১) ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কিছু জায়গায়, বিশেষ করে এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থাকায় আমাদের আপত্তি থাকলেও এ জাতীয় অপরাধের জন্য আমরা আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে আইনের শাসন সমুন্নত হওয়ার পাশাপাশি অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, অপরাধ করে যে পার পাওয়া যাবে না সংশ্লিষ্টদের কাছে সেই বার্তাও নতুন করে পৌঁছাবে।
পিবিআই এর সঙ্গে একমত পোষণ করে আমরাও বলতে চাই, সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এতে নিশ্চিতভাবে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখন তাকে শিগগিরই গ্রেপ্তার করে শাস্তির মুখোমুখি এবং এ ঘটনায় সকল অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হবে বলে আমরা আশা করি।
পিবিআই এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘যেহেতু নারী ও শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসে, তাই নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। নুসরাত অল্প বয়সের মেয়ে ও ছাত্রী। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় মোয়াজ্জেম হোসেনের আরও কৌশলী হয়ে নারী ও শিশুবান্ধব উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন ছিল।’
পিবিআই এর এই মতামতকে আমলে নিয়ে পুলিশ সদস্যদের আরও সহনশীল করতে আরও উদ্যোগী হতে সংশ্লিষ্টদের আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পুলিশের অন্য সদস্যরা ভবিষ্যতে এমন কোনো অপরাধে জড়িত হবেন না বলেই আমাদের আশাবাদ।
ওইদিন যদি ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হতেন তাহলে অপরাধীরা তাকে পরে হত্যা করার দুঃসাহস দেখাতো না । এক্ষেত্রেও ওসি তার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাই নুসরাতের ভিডিও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তার যেমন বিচার হতে হবে, তেমনি ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার দায়-দায়িত্বও নিরূপণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এখানে আমরা আরো একটি কথা বলতে চাই। একজন ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবশ্যই দেশে আইনের শাসন কার্যকর থাকার প্রমাণ দেয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই আমরা সেটা দেখছি না। বিশেষ করে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আমরা এখনো অপরাধীদের চিহ্নিত হওয়ার কথা জানতে পারছি না যা আমাদের হতাশ করে দেয়। আমরা আশা করি, নুসরাত হত্যা মামলায় রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ যেমন আইনের শাসনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ দেখাচ্ছে, তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও সবাই সেটা দেখাবে। না হলে বুঝতে হবে, সব জায়গার জন্য আইন সমান নয়।