মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি এবং ঢাকার প্রাচীন স্থাপনা নিয়ে বইপত্র অনুসারে বিনত বিবির মসজিদটিই ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদ। পুরান ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত মসজিদটি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে এতবার সংস্কার করা হয়েছে যে এর নির্মানকালীন বৈশিষ্ট্য প্রায় পুরোটাই হারিয়ে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও প্রাচীনতম এ স্থাপনাটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করেনি। কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ না থাকায় এর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ঐতিহ্য রক্ষায় মনোযোগ সামান্যই চোখে পড়ে। সম্প্রতি মসজিদটি সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সেনাপতি ইসলাম খানের আগমনের প্রায় ১৫০ বছর আগে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে ৮৬১ হিজরি সালে, অর্থাৎ ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে (১৪৩৬-১৪৫৯ খ্রি.) মারহামাতের কন্যা মুসাম্মাত বখত বিনত এটি নির্মাণ করান।
ইতিহাসবেত্তাদের অনুমান, ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপিসমূহের মধ্যে বখত বিনত মসজিদের শিলালিপিটিই ছিল প্রথম মুসলিম শিলালিপি। শিলালিপিটি মূল মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথে লাগানো ছিল, বর্তমানে এটা উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় প্রবেশ পথের শীর্ষে রয়েছে। এটা একমাত্র মসজিদ, যা একজন নারীর নামে নির্মিত। যদিও বখত বিনতের পরিচয় জানা যায়নি।
সুলতানি আমলে সাধারণভাবে আরবি শিলালিপি পাওয়া গেলেও এখানে আরবির সঙ্গে ফার্সি লিপিরও ব্যবহার লক্ষণীয়। মসজিদের দুটো গম্বুজের একটির গায়ে আদি ভবন প্রতিষ্ঠার সাল লেখা আছে।
মসজিদটি বর্গাকৃতির এবং এক গম্বুজবিশিষ্ট। এর অভ্যন্তরভাগের পরিমাপ প্রতিদিকে ৩.৬৬ মিটার। মসজিদটির ছাদ গোলাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং গম্বুজটি সরাসরি ছাদে স্থাপিত। মসজিদের দেওয়াল ১.৮৩ মিটার পুরু। এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেওয়ালের পেছনের দিকে একমাত্র মিহরাবটি অভিক্ষিপ্ত। আগে চার কোণে প্লাস্টার বিহীন বক্রাকৃতির ‘ব্যাটেলমেন্ট’-যুক্ত চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ ছিল।
বারবার সংস্কার এবং পরবর্তী সময়ে সংযোজনের ফলে এর বাইরের প্রকৃত অবয়ব সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। পূর্বের বপ্রকে সোজা করা হয়েছে। মসজিদটির দক্ষিণ পার্শ্বে আর একটি এক গম্বুজবিশিষ্ট কক্ষ এবং পূর্ব ও দক্ষিণে একটি বারান্দা সংযুক্ত করা হয়েছে। বারবার পুরু আস্তরণের ফলে মসজিদের পোড়ামাটির অলঙ্করণ এখন আর দেখা যায় না।
আরেকটি গম্বুজের লেখা অনুযায়ী ভবনটি প্রথম সংস্কারের মুখ দেখে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে)। বর্তমানে মসজিদটির উত্তর পাশ ছাড়া বাকি সব দিক সম্পূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে মূল মসজিদের ওপর আরও দোতলা করা হয়েছে। বর্তমানে এটা জুমা মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূল মসজিদটির ভেতরের আয়তন ছিল ৩.২ মিটার, আর দেয়ালের গভীরতা ১ মিটার। উত্তর দেয়াল ও গম্বুজের মোজাইক অলঙ্করণ পরবর্তী সময় সংযোজিত। প্রথম সম্প্রসারণে ১৯৩০ সালে দক্ষিণ দিকের দেয়াল ভেঙে মূল মসজিদের সমআয়তন ও গম্বুজ বৃদ্ধি করা হয়। দ্বিতীয় সম্প্রসারণ আরও ব্যাপক আকারে পশ্চিম দিকে সম্পন্ন হয়। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। বর্তমানে পূর্বদিকে একটি বারান্দা যুক্ত করা হয়েছে। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অষ্টকোনা পার্শ্ব স্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে খিলানের ব্যবহার, সাদামাটা অলঙ্করণ, প্লাস্টারে ঢাকা, বাঁকানো কার্নিশ প্রভৃতি।
দীর্ঘদিন এলাকাবাসী একটি কমিটি গঠন করে এ মসজিদটির দেখাশোনা করে আসছেন। মসজিদটিতে নামাজ পরিচালনার জন্য দুই জন ইমাম, একজন খতিব এবং তিন জন খাদেম রয়েছে।
অন্যতম মুয়াজ্জিন আব্দুল হাকিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেম সবার বেতন কমিটিই নির্বাহ করে। বিভিন্ন সময়ে যে সংস্কার হয়েছে তাও কমিটির উদ্যোগেই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের কোন অনুদান নেই।