আমাদের দেশের পরিবর্তনহীন একঘেয়ে রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরেই এরশাদের জাতীয় পার্টিই কিছুটা রসের যোগান দিয়ে আসছিল। দলের চেয়ারম্যান এরশাদের নানা ধরনের সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য থেকে দেশবাসী রসের খোরাক পেত। গত ১৪ জুলাই এরশাদ মারা যান৷ এখন দলটিতে নতুন করে শুরু হয়েছে ‘দেবর-ভাবীর যুদ্ধ’, নতুন সার্কাস।
এরশাদহীন জাতীয় পার্টিতে এখন গৃহবিবাদ তুঙ্গে। দলটি কার্যত দুই ভাগ হয়ে গেছে৷ আর এই দুইভাগের নেতৃত্বে আছেন এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই জিএম কাদের। তারা সম্পর্কে দেবর এবং ভাবি।
জাতীয় পার্টির একাংশ রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করব।” এরশাদের ভাই জিএম কাদের জাতীয় পার্টির ‘গঠনতন্ত্র ভেঙে’ চেয়ারম্যান হয়েছেন অভিযোগ করে আনিসুল বলেন, “জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের সম্মান দেবেন রওশন এরশাদ।”
আর জাতীয় পার্টির অন্য অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। শুধু তাই নয়, রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব পাওয়া জিএম কাদের। তিনি বলেছেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
দলের প্রেসিডিয়ামও তাতে সমর্থন দিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর জিএম কাদের দলের প্যাডে নিজেকে বিরোধী দলীয় নেতার পদে নিয়োগ দিতে স্পিকারকে চিঠি দেন। এই চিঠির পরই দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক প্রকট হয়ে উঠে। দলের ২৫ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৫ জন এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন বলে জানা যায়। কিন্তু পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর রওশন এরশাদ স্পিকারকে দেয়া চিঠিতে জিএম কাদেরের চিঠি নিয়ে বৈধতার প্রশ্ন তুলে তা গ্রহণ না করার অনুরোধ জানান।
এরশাদের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে কে থাকবে তা নিয়ে দলটিতে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছে। এরশাদ যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি নানা কৌশলে দলে বিভিন্ন ধারা উপধারা সামাল দেন। তবে তিনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই তার স্ত্রী রওশন এরশাদ দলে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হন। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে রওশন অনেকটা কোনঠাসা করে ফেলেন এরশাদকে। আর সেটা বুঝতে পেরে এরশাদ তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। রওশন থেকে যান কো-চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমান সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা।
উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালে জন্মের পর এ পর্যন্ত অন্তত ১০ বার দলটি ভেঙ্গেছে। প্রতিটি ভাঙ্গনই ক্ষমতার ভাগ বসানো বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট। জাতীয় পার্টি নামে এখনো দল আছে পাঁচটি।
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনই আছে চারটির। দলটিতে প্রথম ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে এরশাদের কারামুক্তির শর্তে জাতীয় পার্টি সমর্থন দেয়। সেসময় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শেখ হাসিনার কেবিনেটের সদস্য হন। পরে এরশাদ মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বলে বিএনপির সাথে মিলে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেন। মন্ত্রিত্ব না ছেড়ে মঞ্জু ১২ জন সংসদ সদস্যসহ আলাদা হয়ে যান। এরই মধ্যে একবার এরশাদের কথিত বান্ধবী জিনাত মোশাররফকে ঘিরে দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরে।
সেটির নেতৃত্ব দেন কাজী জাফর আহমদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন করেন। তখন কাজী জাফর বলেছিলেন, এরশাদ একটা দুর্গন্ধযুক্ত মরা পচা রাজনৈতিক লাশ। এরশাদ জবাব দিয়েছিলেন এ বলে যে, তিনি চিনি চোর বলে খ্যাত একজনকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ভুল করেছিলেন। অবশ্য এর কিছুদিন পর এরশাদ আর কাজী জাফর কোলাকুলি করে আবার এক হয়ে গিয়েছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। এরশাদ ওই সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদল থেকে বের হয়ে আলাদা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলে নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে জোটের সাথেই থেকে যায়। পরে ওই দলটির নাম দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। ২০০৭ সালে সেনা-প্রভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আবার কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জোটে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর রওশন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেত্রী ও দলের তিনজন মন্ত্রী হলে দলের মধ্যে দুটি বলয় তৈরি হয়। রওশন হয়ে পড়েন সরকারপন্থী। অথচ ১৯৯৬ সাল থেকে যখন আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সখ্য তৈরি হয় তখন থেকেই রওশন বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির মধ্যে নানা সময়ের ভাঙ্গনের এই ইতিহাসই বলে দিচ্ছে কখনোই দলটি নিজস্ব নীতি নিয়ে এগুতে পারেনি। সব সময় কারো না কারো সাথে থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে।
জাতীয় পার্টির এবারের সংকটও ক্ষমতা কেন্দ্রিক। মূলত এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসন শূন্য হওয়ায় ওই আসনের প্রার্থীতা নিয়ে কাদের ও রওশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। রওশন এরশাদ ও তাঁর অনুসারীরা চান এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদ প্রার্থী হোন। অন্যদিকে এরশাদের ভাগনি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুর স্ত্রী জেবুন্নেসা, জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াসিরও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। প্রার্থী হিসেবে এরশাদের আরেক পুত্র এরিক এরশাদের নামও এসেছে; যদিও তাঁর মা বিদিশা চান না তিনি প্রার্থী হোন। এরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যুবক। তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা সম্ভব নয়। সাদ এরশাদ নিজেও প্রার্থী হতে আগ্রহী এবং কয়েকবার রংপুর সফর করেও এসেছেন। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, তৃণমূল থেকে নাম আসবে, এরপর মনোনয়ন বোর্ডে যাঁর জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।
জাতীয় পার্টির বর্তমান যে অবস্থা তাতে এর একাংশ নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যাবে। আর আরেকটি এন্টি-আওয়ামী লীগ ফোরামে বা বিএনপির দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। জাতীয় পার্টির অখণ্ডতা বজায় রাখা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। আসলে স্বৈরাচারের পকেট থেকে জন্ম নেয়া এ ধরনের একটি দল যারা সব রকম নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে কেবল ক্ষমতার শেয়ার হতে চেয়েছে, তাদের পরিণতি এমনই হওয়ার কথা। দলটি সব সময় সুবিধাবাদিতার রাজনীতি করেছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও নানা কৌশলে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যেই থেকেছে। যদিও দলটির সবকিছুই ছিল এরশাদকে কেন্দ্র করে।
‘পারসোনালিটি কাল্ট’ বা ব্যক্তি জনপ্রিয়তা এদেশের রাজনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য, যা জেনারেল এরশাদের মধ্যেও ছিল। যেমন ছিল মওলানা ভাসানী কিংবা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের। কিন্তু এই নেতার মৃত্যুর পর তাদের দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরশাদের জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আপাতত আরও কিছুদিন হয়তো জাতীয় পার্টির নামে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের দল ভাঙ্গার সার্কাসই দেখে যেতে হবে।
আমাদের দেশের সার্বিক রাজনীতিই বর্তমানে অধঃপতিত হয়ে পড়েছে। গত দশকেও রাজনীতি মানে ছিল জনগণের কাছে যাওয়া। জনগণের সেবা করা, সাহায্য করা। বর্তমানে রাজনীতির ধারা বদলে গেছে। এখন একটি পদ নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। এখন রাজনীতি মানে মিডিয়ায় বড় করে খবর আসা, ফেসবুকে পোস্টিং দেয়া, ঝাড়ু নিয়ে ফটোসেশন করা। দেশ গোল্লায় যাক, জনগণ জাহান্নামে যাক, শুধু নিজের সুযোগ-সুবিধাটুকু ঠিক থাকলেই হল।
আগে একজন রাজনৈতিক নেতাকে নিজের অভিভাবক মনে করতো। আর এখন সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতিবিদ মানে ঠিকাদারের দালাল, ভূমিদখলকারী, মাদক ব্যবসায়ী, সরকারি বরাদ্দ পকেটে চালান দেয়ার কারিগর, নিজের পুরো গুষ্টিকে বড়লোক বানানোর ‘আশ্চর্য জাদুকর’!
এমন ‘আশ্চর্য জাদুকরেরা’ যখন নীতি-আদর্শের বুলি আউড়ে দল ভাঙ্গা-গড়ায় অংশ নেন, তখন তা সার্কাস ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এই সার্কাস দেখে আমরা মুগ্ধও হই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)