চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে কি বুয়েটের সমস্যা মিটবে?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন এবং ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে শিক্ষক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবরার ফাহাদ নামে একজন ছাত্রকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার পর সেখানে ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভের মুখে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এই ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সব ধরনের র‌্যাগিং ও নির্যাতন বন্ধের কথাও ঘোষণা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ঘোষণা মতে, এধরনের নির্যাতন প্রতিরোধে একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলা হবে যেখানে পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে পারবে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে আবরার ফাহাদ নামে ওই শিক্ষার্থী নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই নানা মহল থেকে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠে। বুয়েটের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির মধ্যেও অন্যতম দাবি ছিল বুয়েটে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। কর্তৃপক্ষ আপাতত এই কাজটি করে ‘বিপদ’ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু আদতেই কি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে? বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি তো যুগ যুগ ধরেই ছিল। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি তো রাজনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তখন তো ছাত্ররাজনীতির কারণে খুন-মারামারি, হলদখল, টেন্ডারাবাজি, চাঁদাবাজি, র‌্যাগিং, টর্চার রুম ইত্যাদির কথা শোনা যায়নি। গত তিন দশকে কেন ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-দখলদারিত্ব প্রাধান্য পেল? এখন কেন এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের প্রয়োজন দেখা দিল? ছাত্ররাজনীতি কেন, কীভাবে খারাপ হলো? কারা করল?

এদেশে ছাত্ররাজনীতির চরিত্র বদলেছে জাতীয় রাজনীতির হাত ধরে। গত কয়েক দশক ধরে যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন ফ্রাঙ্কেস্টাইনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জামায়াত সব সময় যাবতীয় কুকর্মে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ টাকা পয়সাসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রী থেকে শুরু করে মহল্লার নেতাও ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ব্যবহার করে, পোষে এবং এদের দিয়ে প্রতিপক্ষ দমনের চেষ্টা করে।

এই ছাত্র সংগঠনের নেতারা শিক্ষকদের কাছেও প্রশ্রয় পায়। নানা ‘রঙের’ অনুসারী শিক্ষকরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এই ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন এ ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা পায় বেশি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বড় ধরনের অন্যায় করলেও পার পেয়ে যায়। শিক্ষক-প্রশাসকরা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার বা করার সাহস পান না। হয়তো ইচ্ছেটাও থাকে না। হাজার হোক নিজের দলেরই তো ছেলে!

অনেক হলের সিট বণ্টনের দায়িত্ব পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে থাকে। এই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনই তাদেরকে দেয়। প্রশাসনে বসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশিরভাগই সামান্য কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ছাড়া তেমন কিছুই করেন না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাই যা করার করেন। হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনই বাপ-মা (বিএনপির আমলে যা ছিল ছাত্র দলের হাতে, এখন গত দশ বছর ধরে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দাপট)। আর তাইতো সেদিন আবরারকে নির্যাতনের খবর পেয়ে শেরেবাংলা হলে যাওয়া পুলিশ প্রভোস্টের সঙ্গে যোগাযোগ না করে ছাত্রলীগের সেক্রেটারির সাথে যোগাযোগ করেছে!

ছাত্র রাজনীতির নামে বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা চলছে, সেটা আসলে ছাত্র রাজনীতি নয়।দুর্বৃত্তায়িত অধঃপতিত একটা অপতৎপরতা মাত্র। ছাত্র রাজনীতির নামে এখন যা চলছে সেটা আসলে মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে। এগুলো নতুন করে নিষিদ্ধ করার কিছু নেই। এগুলো দেশের প্রচলিত আইনে এমনিতেই নিষিদ্ধ ও বেআইনি। আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ছাত্র রাজনীতির প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য হলো, মতাদর্শগত অবস্থান। যে আদর্শের তারা চর্চা করবে। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে তাদের একটা ভূমিকা, অবস্থান ও আন্দোলন থাকবে ন্যায্যতা ও ন্যায়ের পক্ষে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা স্রেফ হিংস্রতা, দস্যুতা। ছাত্র সংগঠনগুলো চূড়ান্ত অধঃপতনের শিকার হয়েছে। এর প্রকাশ আমরা দেখেছি বুয়েটে। এখানে কোনো আদর্শের ব্যাপার নেই। কোনো ন্যায় আন্দোলনের ব্যাপার নেই। এখানে সরকারি আনুগত্যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই আধিপত্যে কিছু মেধাবী তরুণ, যারা বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল, তারাই দুর্বৃত্ত হয়ে গেছে। সরকারি আধিপত্যের কারণে ভিন্ন মতের অবস্থান নেই, থাকলেও তা রোধ করা হয়েছে।

ছাত্র রজনীতি বন্ধ করার পর যে পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যাবে-তেমনটা আশা করা ভুল। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। তখন ছাত্রেদের কোনো কন্ঠই থাকবে না। সরকার, প্রশাসনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ থাকবে না। আসলে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা। এটা ছাত্র-শিক্ষক-উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। মূলত তারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন পদ বা সুবিধা পাওয়ার আশায়৷দুই ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতি বন্ধ করে আদর্শিক রাজনীতির চর্চা করতে হবে। ছাত্ররা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। তারা আদর্শিকভাবে দেশের উন্নয়নে ও দেশের কল্যাণে কাজ করবে। ছাত্র রাজনীতিই বন্ধ করে দেওয়া হলে অপশক্তিই সুবিধা পাবে।

ফাইল ছবি

ছাত্র রাজনীতিকে তার গৌরবের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দলীয় আধিপত্যের রাজনীতির বাইরে গিয়ে আদর্শিক ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত ছাত্রদের যদি নেতৃত্বে আনা যায়, যে-কোনো ধরনের অভিযুক্তকে যদি দলে না রাখা হয়, মস্তানি-সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যদি প্রশাসন সোচ্চার থাকে, ছাত্র সংসদগুলোকে যদি কার্যকর করা যায়- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, যেখানে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে বেআইনি কর্মকাণ্ড করা সম্ভব না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিসর নিশ্চিত করার দাবি না তুলে যদি ছাত্র রাজনীতিকেই নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে ভিন্ন নামে ভিন্ন অরাজনৈতিক সাংগঠনিক কাঠামোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা সংগঠনের সুযোগ যেমন থেকে যাবে, সেই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির যে ধারাটি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পক্ষে লড়াই করে, তার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে ওইসব শক্তিই লাভবান হবে, যাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ হুমকিস্বরূপ। মনে রাখা দরকার যে, বুয়েটে আবরার হত্যার পেছনে ছাত্র রাজনীতি নয়, বরং ছাত্র রাজনীতির নামে সরকার ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে একচ্ছত্র সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বই দায়ী।

বুয়েটে যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সপক্ষের কোনও রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় থাকতে পারতো, তাহলে ছাত্রলীগের পক্ষে এরকম বাধাহীন একচ্ছত্র দখলদারিত্ব কায়েম করে হলগুলোকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা, বা আবরার হত্যার মতো ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না। দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি ও আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শক্তিশালী করা এবং তার জন্য যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিসরটুকু দরকার, তার দাবিতে সোচ্চার হওয়া জরুরি। আর দরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তির মানসিকতা দূর করা। হল প্রভোস্ট ও উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশগুলোর আলোকে নিরাসক্তভাবে দায়িত্ব পালন করলেই সমস্যা অনেক কমে যেত।

বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সব ধরনের র‌্যাগিং ও নির্যাতন বন্ধের কথা ঘোষণা করেছে। এধরনের নির্যাতন প্রতিরোধে একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলা হবে যেখানে পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে পারবে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা নেবে। ‘নির্যাতন বন্ধের’ এই ঘোষণা কিছুটা ‘কৌতুককর’। একটি প্রতিষ্ঠান যে কোনো ধরনের অন্যায়-জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে, এটাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। নতুন করে এই ঘোষণা দেওয়ার মানে এটা স্বীকার করে নেওয়া যে, বুয়েটে ‘নির্যাতন’ এতদিন চালু ছিল! যাহোক, বুয়েট কর্তৃপক্ষের এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক। প্রত্যেক হলেই এই ব্যবস্থা চালু এবং কার্যকর করা উচিত।

যদি শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে এবং নাম-পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ জানাতে পারে, এবং সেই অভিযোগের প্রতিকার পাওয়া যায়, তাহলে অপকর্মকারীরা নিরস্ত হবে। অপরাধমূলক তৎপরতা কমে যাবে। এক্ষেত্রে পক্ষপাতহীনভাবে অভিযোগের প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন চাইনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কেউ খুনী হোক-এটাও চাই না। আবার বিশ্ববিদ্যালয় মানবিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তচিন্তার পাদপীঠ না হয়ে সব ধরনের রাজনীতিমুক্ত হয়ে একটা কূপমণ্ডুক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক-সেটাও চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় হোক মুক্তজ্ঞান-চিন্তা ও মুক্তপ্রাণের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)