এক.
খুব খেলতাম লাট্টু।
ফিতা আর লাট্টু সবসময় পকেটে থাকত।
ছোটবেলায় এই খেলায় বিশেষ নৈপুণ্য অর্জন করেছিলাম আমি।
আমাদের শৈশবকালে মহল্লার রাস্তায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আমরা পোঙটা পোলাপাইন লাট্টু নিয়ে খেলতাম- সেই খেলায় ‘বেল্লা পাড়’ ছিল স্বর্গীয় আনন্দের ব্যাপার। যার লাট্টুকে আমরা সবাই লাট্টু দিয়ে ঠেলে ঠেলে- বিষয়টা এরকম ফিতা দিয়ে লাট্টু ঘোরানো হতো তারপর ঝিম হয়ে মাতালের মতো ঘুরতে থাকা সেই লাট্টু কায়দা করে হাতের তালুতে তুলে নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা লাট্টুকে লক্ষ্য করে মারতে হতো- এভাবে এক সময় সেই লাট্টু একটা নির্দিষ্ট সীমানা পার করতে হতো। এই পার করার ব্যাপারটাকে বলা হতো বেল্লা পাড়।
বেল্লা পাড় হওয়া লাট্টুকে লাট্টু দিয়ে কোপ মারা হতো। তবে মাঝে মাঝে এই কোপ মারার ব্যাপারটা হয়ে উঠত দেখার মতো। যে বেচারার লাট্টু বেল্লা পাড়ের বলি হতো তার চেহারা আর দেখার মতো থাকত না।
আহা! কি দুঃখ তার মনে- চোখের সামনে তার লাট্টু কোপের পর কোপে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে।
এই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয় …
দুই.
তবে আমি মাঝে মাঝে করতাম কি প্রায় নির্জন দুপুরে ঘরের বারান্দায় একা একাই লাট্টু ঘুরাতাম। লাট্টুটাকে ফিতায় ভালো করে পেঁচিয়ে। এই পেঁচানোর আবার বিশেষ কৌশল থাকত। লাট্টু পেঁচানোর ওপর নির্ভর করে সে কেমন ঘুরবে- কতটা ঘুরবে।
ফিতায় পেঁচিয়ে যুৎমতন লাট্টুটাকে ভাল করে মেঝের দিকে মারতে পারলেই হল, ভন ভন শব্দ করে সে হেলেদুলে ঘুরতে থাকে।
লাট্টুর এই ঝিম মেরে মাতালের মতো হেলেদুলে ঘুরতে থাকার ব্যাপারটা দেখে আমি খুব আনন্দ পেতাম। আমি সেই ঘূর্ণায়মান লাট্টুটাকে কৌশল করে আঙুল দিয়ে হাতের তালুতে তুলে নিতাম- তখনো সে যেন আগের মতো আম্মার হাতের তালুতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঘুরছে- হেলেদুলে।
লাট্টুটা যখন হেলেদুলে ঘুরত তখন আমি একটা খেলায় মেতে উঠতাম। আমি তখন করতাম কি লাট্টুটাকে কানের কাছে নিয়ে আসতাম- কানের কাছে নিয়ে এলে লাট্টুটার ঘুরতে থাকার ফলে একটা কেমন সুরের ইন্দ্রজাল তৈরি হতো, যা আমাদের বসুবাজার লেনের একাকী দুপুরবেলাকার নিঃসীম নির্জনতাকে ভঙ্গ করে আমার কানে দূরাগত কোনো ঘোড়ার খুড়ের শব্দের মতো বাজত।
তিন.
ছোটবেলার ঘূর্ণায়মান লাট্টুর সেই শব্দ, সেই সুর এখনও আমার কানে বাজে…