দুই দশকের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শাকিব খানের। এরমধ্যে একযুগের বেশি সময় ধরে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি রাজত্ব করছেন। হয়ে উঠেছেন পরিচালকদের আলোক বর্তিকা, প্রযোজকদের আস্থার এক নির্ভরযোগ্য নাম। কাজ করেছেন ওপার বাংলাতেও। অভিনয়, খ্যাতিতে প্রায় আড়াই শ’র মতো ছবির মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
এই যে চলচ্চিত্রের মন্দার বাজার তবুও তিনি আশা জাগাতে পারেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় বাহাদুরি! আলোচনার পাশাপাশি তাকে নিয়ে সমালোচনাও আছে। তারপরেও এখন পর্যন্ত তিনিই ইন্ডাস্ট্রির ত্রাতা! ঈদে তার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ ১৬০টির মতো সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে। ঈদের ছবিসহ বর্তমান ইন্ডাস্ট্রি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের মুখোমুখি শাকিব খান…
যে সময়ে আপনি ‘নবাব’, ‘ভাইজান’, ‘সুপার হিরো’, ‘পাসওয়ার্ড’ নামে সিনেমা করলেন, সেই সময়ে আপনার সিনেমার নাম হিসেবে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ যুঁতসই মনে হচ্ছে না। আপনার কী মনে হয়?
প্রথমে কোনোকিছুই শুরুতে যুঁতসই থাকে না। ‘শিকারি’ যখন করছিলাম শুরুর দিকে অনেকেই বলেছিল, ভাই এই নামে সিনেমা একবার আপনি করছেন, আবার কেন? কেমন হলো নাম! মুক্তির পর কনটেন্টের কারণে দুদেশের মানুষ লুফে নেয় ‘শিকারি’। এর আগে আরেকটা ছবি করেছিলাম ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’। মানুষ এই নাম শুনে হাসাহাসি করতো। বলতো, একেবারে টেকনাফ টু তেতুলিয়া সবই নাকি নামের মধ্যে আছে! কিন্তু মুক্তির পর কী হলো? সুপারহিট তো হলোই, সাথে সাথে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছিল। আমার কথা হলো, মানুষ ছবিটা দেখুক, তারপর বলুক নামটা ছবির গল্পের সঙ্গে যুঁতসই কিনা!
মুক্তির আগে ‘পাসওয়ার্ড’ যেভাবে আলোচনায় ছিল, গানগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত; সেই তুলনায় ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ আলোচিত হয়নি। কেন?
এবার আমি ভিন্ন কিছু হবে ভেবেই কাজ করেছি। গত ঈদের ‘পাসওয়ার্ড’ ছিল একরকম সিনেমা, এবার ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ আরেকরকম সিনেমা। এই ছবি হল দেশ, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে ভিন্নধারার সিনেমা। ট্রেলার দেখে অনেকেই বুঝেছেন। ট্রেলারের প্রশংসা সবাই করছেন। আমি এবার রিয়েলিস্টিক কোনো কিছু দেখাতে চেয়েছি। যেমন- এই সময়ে আমাদের ক্রাইসিস ফুটে উঠবে ছবিতে। আর গানের ব্যাপার যেটা বলা হচ্ছে, সব সিনেমার গান কিন্তু একরকম হবে না।
সিনেমাটাই যেহেতু ভিন্নধারার তাই গানগুলোও গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। অনেকেই এ ধারার গান পছন্দ করেন। যেহেতু ট্রেলার মানুষের ভালো লেগেছে, তাই আমার কথা হচ্ছে মানুষ সিনেমাওটা দেখুক।
ছবির ট্রেলার বলে দিচ্ছে, সাম্প্রতিক ইস্যু ছাড়াও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরীর বার্তা দিতে দেখা যাবে আপনাকে। এরকম সামাজিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছবি করলেন, এটা শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকে?
একেবারে ঠিক ধরতে পেরেছো। একজন শিল্পী যেমন আনন্দ দেবে, তেমনি সে সমাজকে সচেতন করবে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই কাজটা করেছি। অনেকেই বলছে, এই ধরণের ছবিতে কেন অভিনয় করছি? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরণের ছবিতে না কেন? একজন শিল্পী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমারও উচিত সমসাময়িক বিভিন্ন সচেতনতার দিক মানুষের মাঝে তুলে ধরা। আর এটা তুলে ধরার ক্ষেত্রে সিনেমার চেয়ে বড় কোনো মাধ্যম নেই।
আপনি এই ছবিতে আছেন এটা বড় ‘ফ্যাক্ট’। কিন্তু এ কারণ ছাড়া ছবিটি কেন দর্শকের দেখা উচিত?
এটা এমন গল্পের ছবি যেটা নিজের কথা বলবে। সাধারণ মানুষ চলতে গেলে এতো সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়…! এই সমস্যাগুলো আমার জীবনেও কিন্তু হয়। অনেকগুলো ভালো ভালো মেসেজ দিয়ে যাবে এ ছবি, প্রতিবাদের ভাষা শেখাবে এবং গ্রহণ করার ভাষা শেখাবে। সর্বোপরি মারদাঙ্গা সিনেমা থেকে বেরিয়ে জীবনধর্মী সিনেমা বলেই দেখা উচিত ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’। ঈদের ছবি মানেই যদি নাচ, গান, থ্রিলার হয় সেটা তো রোযার ঈদে দেখালাম। এই ঈদে দর্শক অন্যকিছু দেখুক, সেই চিন্তা থেকেই এ ধরণের গল্পে কাজ করেছি। এই ছবিটা প্রত্যেকের মনের কথা বলেছে। এ ছবির গল্পের আলাদা একটা শক্তি আছে। বাণিজ্যিক ছবিতে একজন নায়িকাকে নায়ক যেভাবে গ্রহণ করবে সেটা দর্শক ভুলেও চিন্তা করতে পারবে না।
সারা বছরের মতো শুধু সিনেমা হলে নয়, কয়েকবছর ধরে ঈদ মানেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও আপনার সিনেমার দাপট! এও দেখেছি, সাত দিনব্যাপী ঈদ অনুষ্ঠানের সাতদিনই টিভিতে ‘শাকিব খান ফিল্ম ফেস্ট’ হচ্ছে! বিষয়টি আপনার কাছে কেমন লাগে?
দেখো, এটা কিন্তু খুবই ভালো একটা ব্যাপার। অনেক দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে ভালো ভালো সিনেমা মিস করেন কিংবা তারা আগে দেখেছে আবার দেখতে চায়। তারা আবার বাসায় বসে আনন্দ করে দেখছে। পাশের দেশের দিকে যদি দেখি ওদের কোনো চ্যানেলে আমার নতুন কোনো সিনেমা চলছে একই সময়ে বাংলাদেশের চ্যানেলে চলছে পুরাতন সিনেমা। দেখা যাবে যে, এদেশে আমার ১০-১৫ বছর আগের সিনেমা দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি চাই যে কোনো নতুন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির তিনমাসের মধ্যে টিভিতেও প্রচার হোক। এখানেও নতুন সিনেমা তিনমাসের মধ্যে টেলিভিশনে দেয়ার প্রচলনটা হওয়া উচিত।
চ্যানেলগুলোকে বলতে চাই, আপনারা এমন উদ্যোগ নেন যাতে করে সিনেমা হলে মুক্তির তিনমাসের মধ্যে ছবিগুলো টিভিতেও প্রচার করা হয়। এতে করে চ্যানেলগুলোর টিআরপিও বাড়বে।
উত্তরাঞ্চল বন্যা কবলিত এবং চারদিকে ডেঙ্গু আতঙ্ক। এটা ঈদের সিনেমায় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
মানুষ সিনেমা দেখতে যায় স্বস্তি ও আনন্দ পেতে। বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে মনকে আনন্দ ও তৃপ্তি দেওয়ার জন্য বিনোদন নিতে যায়। সিনেমা দেখার ওই সময়টুকু নিজের মধ্যে থাকতে চায়। স্ক্রিনে ছবি দেখার সময় প্রত্যেকের মন নিজের মতো করে হারিয়ে যায়। এরমধ্যে এসব সমস্যা থাকবেই। পৃথিবী যতদিন থাকবে সমস্যা ততোদিন থাকবেই। সবসমস্যা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
আপনার ছবি মুক্তি মানেই প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া ভিড়। বিশ্বকাপের সিজন কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোনো কিছুকেই দর্শক তোয়াক্কা করে না। কিন্তু ইদানিং ঈদ উৎসব ছাড়া অন্য সময়ে আপনার ছবি আসছে না কেন?
এখন থেকে ঈদ ছাড়া বছরের অন্যসময়েও আমার ছবি দেখা যাবে। আর কেউ করুক বা না করুক এসকে ফিল্মস ছবি করবে। ‘বীর’ তো কোনো উৎসবে রিলিজ হবে না। বছরে ঈদ দুটো কিন্তু এসকে ফিল্মস থেকে ৪-৫ টি সিনেমা রিলিজ হবে।
আমেরিকা গেলে মানুষ হলিউড দেখতে যায়, ইন্ডিয়া গেলে রামুজি ফিল্ম সিটিতে ঘুরতে যায়। একসময় মানুষ গ্রামগঞ্জ থেকে ঢাকা এলে এফডিসি দেখতে আসতো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আপনি নিজেও এফডিসি দেখতে এসে হয়ে গেলেন বাংলা সিনেমা শীর্ষ নায়ক! এখন এফডিসির সেই জৌলুস নেই। ওই হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হলে করণীয় কী? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
ঠিকই বলছো, এখন আর সেই অবস্থা নেই, জৌলুস নেই। কারণ, এফডিসি পুরোপুরি সিস্টেমের বাইরে একটা নোংরা জায়গায় পরিণত হয়েছে। এফডিসির কাজ হলো শিল্প, সিনেমা, গানের চর্চার পরিবেশ অনুকূলে রাখা। এখানে শিল্পাঙ্গনের ভালো ভালো উচ্চশিক্ষিত মানুষের আড্ডা, আনোগোনা থাকা উচিত, যেটা আগে ছিল। কিন্তু দেখো এখন মেধাবী মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। ডিরেক্টোরিয়াল দিক থেকে কিংবা প্রযোজকদের দিক থেকে মন থাকতে হবে, আমি একটা ভালো সিনেমা বানাবো। রুচি ঠিক রাখতে হবে, ব্যবসার কথাও মনে রাখতে হবে। এসব মানুষদের এখন এফডিসিতে দেখা যায় না কেন? এর কারণ, শিল্প চর্চার জায়গা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। মাথার মধ্যে রাজনীতি নিয়ে ঘুরলে তো আর সৃজনশীল কাজ হয় না। এখন অবশ্য আগের চেয়ে কিছুটা হলেও কমে গেছে। যে যার জায়গা থেকে বুঝতে পারছেন বলেই এখন অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে। যারা কাজ করছে তাদের উদ্যোমী হতে হবে, যারা বসে আছে তাদের ভালো ভালো কাজ করতে হবে। সুনামীর শেষে তো সবকিছু আবার নতুন করে তৈরি হয়। লেটস সি…! আমরা আবার সেই জৌলুসের দিনে ফিরে যাবো।
এসকে ফিল্মস থেকে সিনেমা হলে মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া কারণ কী? এটা নিয়ে নাকি ঝামেলাও হচ্ছে?
মামলা করার হুমকি আসছে। কিন্তু এর কারণ কী? ইন্ডাস্ট্রি কারো পারিবারিক সম্পত্তি নাকি? একজন প্রযোজক যখন ছবি রিলিজ করছেন তিনভাগের একভাগ টাকা তাকে দিয়ে দিতে হচ্ছে। গত ঈদে ‘পাসওয়ার্ড’ রিলিজ করে একজন প্রযোজক হিসেবে দেখেছি, হলে যেসব মেশিন বসানো সেগুলো খুব করুণ। অকেজো ওইসব মেশিনের জন্য প্রযোজক হিসেবে সপ্তাহ প্রতি আমাকে সাড়ে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। ‘এসকে বিগ স্ক্রিন’ না এলে এই ঈদেও ডাবল টাকা ভাড়া দিতে হতো। আমার টাকার ছবি না হোক, আমারই তো ছবি। সুফল তো আমার প্রযোজক পাবে! কিন্তু আমি মোট ভাড়ার তিনভাগের একভাগ নিচ্ছি। যেটা খরচ সেটাই নিচ্ছি। কারণ, একজন প্রযোজক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে আগের স্ক্রিনে ভালো দেখা যাচ্ছে না সিনেমা, ঘোলা আসছে। তাহলে আমি ওইসব পুরাতন স্ক্রিনে এই বাড়তি টাকা কেন দেব? এই ঈদে ছবি রিলিজ দিতে যদি ৮-১০ লাখ টাকা বেঁচে যায় তাহলে তো আমার প্রযোজকের লাভ। যেটা আমি বাড়তি দিয়েছি চাইনা আমার প্রযোজক সেটা বাড়তি খরচ করুক।
অনেকেই বলছেন, মেশিন বসিয়ে আপনি প্রেক্ষাগৃহ নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইছেন?
এটা পুরোপুরি ভুল কথা। মেশিন ভাড়ায় শুধু শুধু এতোগুলো টাকা দিলাম সেগুলো আমাকে কে ফেরত দেবে? কোটি কোটি টাকা লগ্নি করছি আমি, সুবিধা পাবে সবাই। আমি তো বছরে ছবি করবো ৪টা থেকে ৬টা। বাকি সময়ে কিন্তু অন্যদের ছবিই চালাতে হবে। যদি নিজের স্বার্থ বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইতাম; তাহলে ‘বীর’ রিজিলের সময় মেশিন বসাতাম। ‘পাসওয়ার্ড’ মুক্তির পর মনে হয়েছে আমাকে আগে ভালো প্রজেকশনের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে ছবি কই দেখাবো। শুধু মেশিন নয়, এসকে ফিল্মস থেকে ২০-২৫টা বন্ধ হল লিজ নিয়ে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হয়তো এ বছরের মধ্যে কিছু একটা হতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভালো ভালো সিনেমা নিতে চাই, যেগুলোর পজিশন ভালো। নতুন করে চালু করলে আবার দর্শক সেখানে আসা শুরু করবে। হাজার সিট দরকার নেই, ৩০০ সিটের হলেই হবে। তবে পুরোপুরি আধুনিকভাবেই ওইসব হলগুলো বানাবো।
আপনার উদ্দেশ্য সফল হোক। শুভ কামনা আপনার জন্য…
ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকুক, নিরাপদে ঈদ করুক।