সরকার করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে পরিপত্র জারি করেছে। এতদিন স্বাভাবিকভাবেই এই পরীক্ষার সুযোগ বিনামূল্যে থাকলেও এবার এখানে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। করোনার সংক্রমণ দিন দিন বাড়তে থাকার প্রেক্ষিতে এবং করোনাকালে দেশের অধিকাংশ মানুষ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ার সময়ে সরকার এই ফি নির্ধারণ করল। এই ফি নির্ধারণ একদিকে যেমন বাস্তবতাবিবর্জিত অন্যদিকে দেশের করোনা সংক্রমণের বিস্তারের জন্যে সহায়ক হয়ে ওঠতে পারে।
গত ২৮ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত ‘কোভিড-১৯ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইউজার ফি’র হার নির্ধারণ’ শিরোনামের পরিপত্রে বলা হয়, আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নির্ণয় করা হয়। বর্তমানে এ পরীক্ষা সরকার বিনামূল্যে করার সুযোগ দিচ্ছে। ফলে কোনো উপসর্গ ছাড়াই অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের গত ১৫ জুনের এক স্মারকের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি নির্ধারণ করা হলো। এতে আরও বলা হয়, আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা বিধিমালা ১৯৭৪’-এর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, দুঃস্থ ও গরীব রোগীদের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ বহাল থাকবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয় এই পরিপত্রে। পরিপত্র অনুযায়ী, এখন থেকে বুথে গিয়ে করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এলে ফি দিতে হবে ২০০ টাকা। আর বাসায় গিয়ে কারও নমুনা সংগ্রহ করতে হলে সেক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি লাগবে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষাতেও খরচ হবে ২০০ টাকা। সরকারি সব হাসপাতালের জন্য এ ফি প্রযোজ্য হবে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত যখন আসলো তখন বাংলাদেশে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। দেশে কার্যত ঘোষিত লকডাউন নেই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের অনেকের মধ্যেও এই স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন নেই। প্রতিদিন দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে এবং প্রতিদিনই বিশ শতাংশের ওপর থাকছে করোনা শনাক্ত রোগী, প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর জানানো হচ্ছে বুলেটিনে। এমন অবস্থায় আমাদের যখন আরও বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার কথা ছিল সেখানে সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই করোনা পরীক্ষাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টাটাই চোখে পড়ল।
সরকার বলছে- কোনো উপসর্গ ছাড়াই অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ গ্রহণ করছেন। উপসর্গ ছাড়া কেউ যদি পরীক্ষার সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন তারা কারা? তাদের অধিকাংশই নিশ্চিতভাবে সাধারণ মানুষদের কাতারে থাকা কেউ নন। কারণ সরকারিভাবে বিনামূল্যে যখন নমুনা পরীক্ষা হচ্ছিল তখন এই নমুনা দিতে সাধারণ মানুষদের একটা ইন্টারভিউয়ের মত অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। উপসর্গ আছে সেটা প্রমাণ দেওয়ার পরেই তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সরকার-প্রশাসনের লোকজন মুখে বলেছে নমুনা দিন-নমুনা দিন, কিন্তু এই নমুনা দিতে গিয়ে মানুষ যে ভোগান্তির শিকার হয়েছে সেটা ভুক্তভোগীরা জানে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্রে আমাদেরও চোখে পড়েছে। ফলে উপসর্গ ছাড়াই সাধারণ মানুষের পরীক্ষার সুযোগ নেওয়ার যে দাবি সেটা অসত্য এবং অতিরঞ্জন।
হ্যাঁ, এখানে অনেক লোক উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করিয়েছে; তারা কারা? এরা ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা লোকজন, এবং তাদের আত্মীয়স্বজন ও তাদের সেবাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। হতে পারে তাদেরও নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল, কারণ পরিবারের কোন সদস্য এবং করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে থাকা কারও নমুনা পরীক্ষার দরকার হয়। সেটা হয়েছে এক্ষেত্রে। এখানে উপসর্গ না থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ অনুচিত। ঢালাওভাবে কেউ করোনা পরীক্ষা করিয়েছে এমন হলে করোনা শনাক্তের ১১৫তম দিন মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে মাত্র ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই সংখ্যাকে ‘মাত্র’ বলছি কারণ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এটা নেহায়েত দরিদ্রতম এক সংখ্যা। ওয়ার্ল্ডোমিটারে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ২৯ জুন পর্যন্ত করেছে ৮৬ লাখের বেশি টেস্ট, পাকিস্তান করেছে প্রায় ১৩ লাখ টেস্ট, ৩ কোটির কম জনসংখ্যার দেশ নেপাল করে ফেলেছে সোয়া ৫ লাখ টেস্ট। সেই হিসাবে আমাদের সংখ্যাটা খুবই কম। তার ওপর এখন আবার এখানে নমুনা পরীক্ষার ফি চাপিয়ে দেওয়ার কারণে এই টেস্টের প্রবণতা আরও কমবে। এতে করে দেশ ক্রমান্বয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। করোনা মহামারি নীরব ঘাতক হিসেবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে থাকবে কিন্তু এগুলো সরকারি হিসাবে আসবে না কখনই।
করোনাভাইরাসের আক্রান্তদের সকলের উপসর্গ প্রকাশিত হয়না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বৈশ্বিক এই সংস্থাটি বলছে করোনা আক্রান্ত সকল রোগীর ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রকাশিত না হলেও তাদের থেকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে উপসর্গ না থাকলেও পরীক্ষা হয়েছে এমন দাবি করে সেখানে সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া রোগের চরিত্র অনুযায়ী অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক। এখানে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা ফি নির্ধারণ কোনোভাবেই দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়। অনেকের মনে হতে পারে— ২০০ টাকা খুব বেশি টাকা নয়, কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষদের কাছে এই টাকাটা এখনও অনেক। করোনার কারণে দেশের অনেকেই উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা বেকায়দার মধ্যে রয়েছেন। এমন অবস্থায় যেকোনো সংখ্যার টাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। এছাড়াও একটা পরিবারের একাধিক সদস্যের করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়লে এই ২০০ টাকার সংখ্যাটা তখন আর দুইশ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। একজন নিম্ন আয়ের মানুষ করোনা আক্রান্ত হলে তার পরিবারের বাকি সদস্যদের নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়লে তখন টাকার সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবেছেন? এছাড়াও আছে নমুনা পরীক্ষার ফি জমা দেওয়ার ঝক্কি। সরকার যে কোড উল্লেখ করে দিয়েছে সেটা যদি সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দিতে হয় তখন সেখানেও আরেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে করোনার উপসর্গ থাকা সাধারণ মানুষদের। এখানে রোগ বিস্তারের পথকে কি উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে না?
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন নমুনা পরীক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করত মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে নানা গণমুখী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে করোনা নিয়ে যা কিছু চলছে সেটা নেহায়েত অমানবিক। ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশে এখনও আমরা দৈনিক বিশ হাজারও টেস্ট করাতে পারছি না। পরীক্ষার ফল আসতে এমনই বিলম্ব হচ্ছে যে এই সময়ে নমুনা দিয়ে আসা লোকজন হয় মারা যাচ্ছেন, নয়ত সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে আমাদের সবকিছু। এমন অবস্থায় হঠাৎই নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়ে সাধারণ মানুষদের আরও বেকায়দায় ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করি। ফি নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে দেশে নমুনা পরীক্ষার হার কমবে, মানুষ পরীক্ষা করতে নিরুৎসাহ হবে।
করোনার নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেওয়া সরকারের মানবিক কোন সিদ্ধান্ত নয়। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)