চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এরা কি তবে বাংলাদেশ হেটার্স প্রজন্ম?

বিদেশে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ মানে কি অচ্ছুত কিংবা নিষিদ্ধ কিছু? তাদের দৃষ্টিতে যা কিছু খারাপ সব থাকুক বাংলাদেশে! ভাল কিছু সব থাক বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর সেখানকার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগি সংগঠনগুলো বিমানবন্দরে বিক্ষোভ করেছে, প্রতিবাদ করেছে এবং তাঁকে ‘খুনী’ আখ্যা দিয়ে লন্ডন ‘লজ্জিত’ হয়েছে জানিয়ে বলেছে ‘খুনী ফিরে যাও’!

এর আগেও আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন বিদেশ সফর করেছেন তখন বাংলাদেশে তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সেখানকার নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ করেছে। কালো পতাকা দেখিয়েছে, ডিম ছুঁড়ে মেরেছে প্রবল আক্রোশে।

এসব কোনোক্রমেই সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা নয় তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ রীতি চলে আসছে। দৃশ্যমানভাবে সভ্য দেশে বসবাসকারীদের এমন অসভ্য আচরণের জন্যে দলের পক্ষ থেকে তারা শাস্তি না হোক অন্তত তিরস্কৃত হয়েছে এমন নজির নাই। উল্টো অভিযোগ আছে, গর্হিত এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে তারা পুরস্কৃত হয়েছে পদ পদবী বাগিয়ে নিয়ে- বিষয়টি সত্যিকার অর্থে লজ্জা ও আতঙ্কের!

গত জুনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাজ্য সফরে যান তখন তিনি বিএনপি নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান করা লন্ডনের হিলটন হোটেলের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়ে ডিম ছুঁড়তে গিয়ে সেদেশের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল এক বিএনপি কর্মী।

বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে প্রকাশ, সেখানকার বিএনপির কিছু নেতাকর্মী নাকি গাড়িতে আক্রমণের জন্যেও উদ্যত হয়েছিল। প্রতিবাদ কর্মসূচির নামে ব্যানারে লিখেছিল ‘কিলার গো, কিলার হাসিনা গো এওয়ে’ সহ বিভিন্ন ব্যানার। এরপর পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল।

যারা এসব কাণ্ড করে তাদের সকলেই প্রবাসী বাংলাদেশী, এবং কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তাদের আক্রোশ মূলত প্রতিপক্ষ দলের সর্বোচ্চ নেতা। এসব ঘটনা কেবল লন্ডনেই ঘটে তা নয়, আমেরিকা সহ পৃথিবীর সেখানেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা আছে সেখানেই ঘটে থাকে। ফলে দেশের বাইরের মানুষদের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে খারাপ ধারণার জন্ম দেয়।

অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেখানকার নেতারা এসবকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশী নয় এমন বিদেশিদের কাছে আধো বাংলা, আধো ইংরেজির স্লোগানগুলো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও ব্যানার, প্ল্যাকার্ডে লেখা স্লোগানগুলো ঠিকই ইংরেজিতে এবং একারণে তা বিদেশিদের কাছে পাঠযোগ্য।

ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের সর্বোচ্চ নেতা সম্পর্কে যে তারা ভাল ধারণা পোষণ করবে তা নয়। যার প্রভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বেড়ে ওঠবে!

বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতির কতখানি আর খবর রাখে? আমাদের অধিকাংশই যেমন অন্যান্য দেশের রাজনীতি সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা রাখি না, স্টাডি করি না ঠিক একইভাবে তারাও, কিন্তু যখন কোন প্রতিবাদ আসবে, এ ধরণের প্রতিরোধমূলক কোনো কর্মসূচি আসবে তখন প্রতিবাদকারীদের বক্তব্যগুলোই চোখে পড়বে, স্বাভাবিকভাবেই।

প্রবাসে থাকা প্রত্যেক বাংলাদেশী একেক জন স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশের দূত। তাদের কীত্তিকলাপ সব বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের অর্জন কিংবা যে কোন কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত একজন বাংলাদেশী হিসেবে ওখানে প্রতিষ্ঠা পায়। সে হিসেবে তারা ভাল কিছু করলে যেমন সেটা বাংলাদেশের অর্জনের খাতায় যোগ হবে, ঠিক একইভাবে খারাপ কিছু করলে সেটাও বাংলাদেশের রেপুটেশন লস হিসেবে চিহ্নিত হবে।

গত বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) চিকিৎসার জন্যে লন্ডন গেছেন বেগম খালেদা জিয়া। সেখানে চিকিৎসার জন্যে গেলেও দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে তার সাক্ষাৎ হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারেক রহমান সাত বছর ধরে চিকিৎসার নামে ওখানে আছেন, প্রয়াত আরাফাত কোকোর পরিবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে বলা যায়, খালেদা জিয়া পরিবারের সবাই এখন লন্ডনে।

‘ওয়ান্টেড’ হিসেবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেডঅ্যালার্ট জারি আছে। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর কোনো পুলিশই তারেক রহমানকে খুঁজে পাচ্ছে না, কিন্তু তিনি তার মা’কে গাড়িতে নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি নিয়ে গেছেন- এমনটাই মিডিয়ায় সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে।

খালেদা জিয়া লন্ডনের হিথ্রোতে বিমানবন্দরে আওয়ামীপন্থী নেতাকর্মীদের বিরূপ অভ্যর্থনার মুখোমুখি হয়েছেন। ‘গো ব্যাক মার্ডারার’ লেখা সম্বলিত ব্যানার দেখানো হয়েছে তাকে। আওয়ামীপন্থী নেতাকর্মীদের অভিযোগ বছরের শুরুতে দেশব্যাপী নাশকতার জন্যে খালেদা জিয়া দায়ি।

এ বছরের শুরুতে আন্দোলনের নামে পেট্টোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যায় দেড় শতাধিক। বাংলাদেশে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে গ্রামের সাধারণ কর্মীও এর জন্যে খালেদা জিয়াকে দায়ি করে থাকেন, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। অবস্থাটা এমন বক্তৃতাতেই যখন স্বার্থসিদ্ধি আইন প্রয়োগের আর দরকার কী?

‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুক্তরাজ্য শাখা’ ব্যানারে দৃশ্যমান সে বিরূপ অভ্যর্থনাকারী খালেদা জিয়াকে খুনী হিসেবে আখ্যা দিয়ে লন্ডনে স্থান দিতে চান না। খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে তারা বলছে, ফলে ধারণা করা যায় তাদের দৃষ্টিতে খুনীর স্থান লন্ডন হতে পারে না; খুনীদের স্থান কেবল বাংলাদেশে!

যারা বানার হাতে দাঁড়িয়েছিল তাদের চেহারার দিকে তাকালে বয়স সম্পর্কে বলা যায় তারা অনতি তরুণ। তবে এ প্রতিবাদকারী উপস্থিতির যাদের নাম মিডিয়ায় এসেছে তারা সবাই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ কমিটির সব পদস্থ নেতা। এ প্রসঙ্গে যদি শেখ হাসিনাকে অপমান করা সে দলের নেতাকর্মিদের কথা মনে করা যায় তাহলে দেখা যায় সে তারাও ছিলেন বিএনপির পদস্থ নেতারা। এটা লজ্জার যে এটাই হচ্ছে প্রবাস রাজনীতির চালচিত্র!

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আওয়ামী লীগ- বিএনপি এধরণের কথিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে থাকে যেখানে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতাকে সর্বোচ্চ অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের নজির সৃষ্টি করে। দুই দলের নেতাকর্মীরাই প্রতিপক্ষ দলের নেতাকে ‘খুনী’ আখ্যা দিয়ে লন্ডনে স্থান দিতে চায় না। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জড়িত খুনী চৌধুরী মঈনুদ্দিনের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।

রাজাকার মঈনুদ্দিন সেখানকার জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে তার নিয়ন্ত্রাণাধীন এক মসজিদের মাধ্যমে সেখানে জঙ্গিবাদকে লালন করছে। তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিয়েছে কয়েক জন এমন খবর মিডিয়ায় এসেছে।

বিএনপি-জামায়াত আদর্শিকভাবে কিংবা জোটগতভাবে একে অন্যের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ বলে চৌধুরী মঈনুদ্দিন সম্পর্কে তাদের কোনো বক্তব্য নেই কিন্তু সেখানকার আওয়ামী লীগের থাকবে না কেনো? তারা খালেদা জিয়াকে লন্ডনে কয়েক সপ্তাহের জন্যেও স্থান দিতে চান না কিন্তু রাজাকার মঈনুদ্দিন সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করলেও আপত্তি নাই! এ কেমন ভাব; এ কেমন দৃষ্টি?

গত কয়েক মাসে বেশ ক’জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ব্রিটিশ বাংলাদেশী এক পরিবারের ১২ সদস্যের আইএসে যোগদান বিষয়ে। এ পরিবারটি বাংলাদেশে এসেছিল এবং বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে না গিয়ে সিরিয়ায় আইএসের সঙ্গে যোগ দেয়। এছাড়াও যারা আইএসে যোগ দিয়েছিল তাদের সবাই বয়সে তরুণ। ফলে এটা বলা যায়, বৃটিশ বাংলাদেশী তরুণদের মধ্যে জঙ্গিবাদ বাসা বাধছে এবং ক্রমে তারা ধ্বংসের অতলে নিপতিত হচ্ছে।

বৃটিশ বাংলাদেশীদের কেউ যখন সফল হচ্ছে তখন তার জাতীয়তার পরিচয় বৃটিশ হলেও পূর্বপুরুষের পরিচয়ও আলোচনায় আসছে। উদাহরণ হিসেবে রুশনারা আলী, রূপা হক ও টিউলিপ সিদ্দিক যখন হাউস অব কমন্সে নির্বাচিত হন; তখন বিশ্বমিডিয়া তাদেরকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বৃটিশ পরিচয়ও দিয়েছে। একইভাবে আইএসে যোগ দিচ্ছে যে সব বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা তারাও বাংলাদেশের পরিচয়ে কালিমা লেপ্টে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের বাইরে যে সব প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে তারা আদতে বাংলাদেশকেই অপমান করছে। ভিন দেশের ভিন্ন পরিবেশে যারা অপমানিত হচ্ছে তারা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা, তারা একাধিক বার সে সব দেশের সরকারের আমন্ত্রণে সেখানকার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন।

এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দেশের বাইরে বাংলাদেশকে সরকারিভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন, খালেদা জিয়াও এক সময় একই পরিচয়ে সেখানকার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন, এবং এখনও গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং দেশের বাইরে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এসব ন্যাক্কারজনক কর্মসূচি আদতে দেশকেই অপমান করছে।

যে তারুণ্য অথবা বিগত তারুণ্য এই মুহুর্তে কাউকে ‘খুনী’ আখ্যা দিয়ে লন্ডন নয় বাংলাদেশই খুনীদের স্থান বলে ঘোষণা করছে তারা ভুলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের এধরণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্দেশ করছে, কেননা কেউ সজ্ঞানে ‘ঘোষিত খুনীকে’ নির্বাসন অথবা স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে তার দেশকে নির্দেশ করবে এমন হওয়ার কথা নয়।

আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি কিংবা খালেদা জিয়া, বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হতে পারেন কিন্তু বাংলাদেশকে কোনোক্রমেও প্রতিপক্ষ ভাবা উচিত নয়।

খুনী ফিরে যাও, বাংলাদেশে ফিরে যাও- কেনো খুনীর স্থান বাংলাদেশেই হতে হবে কেনো? কষ্টভাবনায় ভাবলে বলতে হয়, এরা কি তবে বাংলাদেশ হেটার্স প্রজন্ম? বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করতে পারি না; বিশ্বাস করতে চাই না! কারণ এসব অনতি তরুণ ভুলভাবে পরিচালিত হলেও কোন এক সময় হয়ত টের পাবে আদতে কী বলতে গিয়ে কী বলছে তারা!

প্রবাসে থাকা তারুণ্য কিংবা বিগত তারুণ্যের রাজনৈতিক নেতাকর্মীর কাছে বিনীত আবেদন রাজনৈতিক খেলায় জিততে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ ভাববেন না, প্লিজ!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)