যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের পরিচালক জেমস কোমিকে আচমকা বরখাস্ত করার ঘটনাটি যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই। জনগণ তো দূরের কথা, কংগ্রেস, কনজারভেটিভ অঙ্গন, এমনকি খোদ এফবিআইয়ের কেউও চিঠি পাওয়ার আগে জানত না কোমিকে বরখাস্ত করা হতে পারে।
এ ঘটনায় রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এখন একটি বড় প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে: কোমির চাকরিচ্যুতি কোনো কিছু ঢাকার চেষ্টা নয় তো?
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে (বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোরে) হঠাৎ করেই হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এক লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়, জেমস কোমিকে চাকরিচ্যুত করে তার কার্যালয় থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
৫৬ বছর বয়সী কোমি চার বছর আগে দশ বছরের জন্য এফবিআই পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মঙ্গলবার লস অ্যাঞ্জেলেসে এফবিআই এজেন্টদের সামনে বক্তব্য দানের সময় তার এক সহযোগী তার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেন। সেখানে লেখা ছিল, কোমিকে এফবিআই প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। চিরকুটটি পড়ে প্রথমে একে রসিকতা মনে করে জেমস কোমি হেসে ফেলেন বলেও জানায় বিবিসি।
কিন্তু ঘটনাটি রসিকতা ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে চিঠি পাঠিয়ে এফবিআই প্রধানকে বরখাস্ত করেন। আর এর কারণ হিসেবে জানানো হয়, নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল কেলেঙ্কারি তদন্ত সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে ত্রুটি থাকায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
কিন্তু হিলারির দল এই কারণটা মানতে নারাজ। কোমি সপ্তাহখানেক আগেই সিনেট কমিটির সামনে বলেছিলেন, তিনি ও তার সংস্থা এফবিআই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা এবং ওই সময় ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় দেশটির সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত করছেন।
আর ডেমোক্র্যাটদের দাবি, এ কারণেই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নইলে গত বছরের ঘটনায় এখন কেন কোমির চাকরিচ্যুতি? যুক্তি হিসেবে তারা তুলে ধরছেন গত বছর নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগের কথা, যখন ট্রাম্প নিজেই বারবার এফবিআই প্রধানের প্রশংসা করেছেন হিলারির ই-মেইলের তদন্ত তিনি পরিচালনা করছেন বলে।
সরকার যেখানে হিলারিকে আইনি ব্যবস্থা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, সেখানে এর বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কোমির অনেক সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে বলে একটি প্রচারণা র্যালিতে বলেছিলেন ট্রাম্প।
এই বৃহস্পতিবারই কোমির কংগ্রেসে আবার হাজির হয়ে এ ধরণের সংশ্লিষ্টতার ‘বিশ্বব্যাপী চলমান হুমকি’ সম্পর্কে আলোচনা করার কথা ছিল। অথচ তার আগেই তাকে পদ ছেড়ে দিতে হলো। তাও আবার কোমিকে বের হওয়ার দরজাটা দেখিয়ে দিলেন সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি বরাবর রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি সম্পাদকীয়তে বলাও হয়েছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের মন কোমির প্রতি বিষিয়ে উঠেছে এবং সপ্তাহখানেকেরও বেশি সময় ধরে তিনি তাকে (কোমি) চাকরিচ্যুত করার
সুযোগ খুঁজছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনতে পারে এমন তদন্ত থামানোর জন্য’ ট্রাম্প কোমির চাকরি খেয়েছেন।
জেমস কোমির চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে ২০১৬’র নির্বাচনে রুশ সম্পৃক্ততা বিষয়ক তদন্ত ভুলখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে – মঙ্গলবারই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন হোয়াইট হাউজ উপদেষ্টা কেলিয়্যান কনওয়ে। কোমির বরখাস্তের চিঠি ইস্যুর পর সিএনএন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা নয়। আপনারা চান এটা রাশিয়া বিষয়ক হোক। যেখানে এটি আসলে এফবিআইয়ের সম্মান পুনরুদ্ধার এবং ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কিত।’
নিজের কথার সমর্থনে কনওয়ে কোমিকে ট্রাম্পের পাঠানো বহিস্কারপত্র দেখান, যেখানে বলা হয়েছে, এফবিআই পরিচালক তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে ট্রাম্পকে বলেছেন, এফবিআইয়ের তদন্তের লক্ষ্যবস্তু ট্রাম্প নন।
আবার সিএনএনের ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক অ্যান্ডারসন কুপার যখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন, ট্রাম্প হিলারির বিরোধিতা করার জন্য বারবার কোমির বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্তকেই ব্যবহার করেছেন, তখন আবার নিরাপদ থাকতে কনওয়ে কথা ঘুরিয়ে ফেলেন: আমার মনে হয় আপনি ভিন্ন
প্রসঙ্গের কিছু বিষয় এখানে টেনে আনছেন।
তবে সবকিছুর পরও এটাই বলতে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ সরকার এবং এফবিআইয়ের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য, বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য এবং কোমির দোষের শাস্তি হিসেবে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলে দাবি করলেও এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তার প্রতি সন্দেহের তীরটা যেন আরেকটু বেশি ঘুরে গেছে।
অন্তত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন। যেমন ডেমোক্রেটিক কৌশলগত বিশ্লেষক ডেভিড অ্যাক্সেলরড রো সরাসরিই বলেছেন, এফবিআই পরিচালক জেমস কোমিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় অনেক বড় একটা আঘাত।