মানুষ ছুটছে; কেবল ছুটছে। সকাল থেকে মধ্যরাত। দেখে-বুঝে যতটুকু টের পাওয়া যায় তাতে মনে হয় কারও অবসর নেই। দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়ার, একবার নিজেকে নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই কারও। এমনি তাড়ার শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা। এই শহরে তাড়াটা এতই যে প্রধান সড়কে বিপদজনক রাস্তা পারাপারে মানুষের স্রোত ঠেকাতে দড়ি বাঁধতে হয়; লাঠি হাতে হুঙ্কার দিতে হয় পুলিশকে।
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এলাকার প্রধান সড়কে দৃশ্যটি সবসময় এমনই দেখা যায়। পাশেই একটি ফুটওভার ব্রিজ। সেই ব্রিজে অনেক অনেক টাকা খরচ করে সংযোজন করা হয়েছে চলমান সিঁড়ি (অবশ্য নানা জটিলতায় দুটিকের সিঁড়ি অকেজো রয়েছে) তারপরও মানুষ দল বেধে, ঝুঁকি নিয়ে, মহাসড়কের গাড়ি হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে পারাপার হচ্ছে। বনানীর কাকলী মোড় থেকে ১১ নম্বর সড়কের মোড়, ২০ সেকেন্ডের হাঁটা দূরত্বে দুটি ফুটওভার ব্রিজ। একটি আছে চলমান সিঁড়ি। তারপরও মানুষ ছুটছে ব্রিজের তলদিয়ে। প্রায়ই শিশুকোলে মা; ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে বাবাকে দেখা যায় এই বিপদজনক পারাপারে শামিল হতে! এসব দেখে-শুনে কেবল একটি প্রশ্ন সব এলোমেলো করে দেয়, এতো তাড়া কেন আমাদের? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
দুই.
খুব দূর অতীত নয়, এই শহরের মানুষের এতো তাড়া ছিলো না তখন। অভাব ছিলো, সেই সঙ্গে শহরের একটা ছন্দময় গতিও ছিলো। এমন উদাম প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা আমরা দেখিনি তখন। শহরের কোণায় কোণায় মায়াজড়ানো একটা ভালোবাসা ছিলো। তখন রাতের কোনো একটা প্রহরে এই শহর ঠিকঠাক ঘুমিয়ে যেতো। আর এখন ঠিক আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের মতো ‘নির্ঘুম রাতের শহর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা। দক্ষিণের বুড়িগঙ্গা থেকে উত্তরের তুরাগতীর জেগে আছে সব সময়। বধির করে দেয়া শব্দতুলে সারাক্ষণ ছুটছে গাড়ি। ছুটছে মানুষ। ১৯৯০ সালে হংকং শহরে সকালে, বিকেলে, মধ্যরাতে, ভোরে মানুষের স্রোত দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম- মানুষ এভাবে ছোটে কেন? কোথায় যায়? তার ঠিক ২৫ বছর পর দুনিয়ার রাজধানী বলে খ্যাতি পাওয়া নিউইয়র্ক গিয়ে সেই প্রশ্নটা আবার নতুন করে জেগে উঠেছিলো। তারও অনেক অনেক আগে জগতময় আলোড়নতোলা কবি লোরকা ওই শহরকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লিখেছেন আর শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য সিটি অব স্লিপলেস’। আর অস্বাভাবিক গতিতে ঢাকা শহর তেমনি হয়ে গেলো। পরিস্থিতি এমন যে সদা জেগে থাকা এই শহরে মানুষ এখন আর ঘুমানোর সময় পায় না। মানুষের ক্লান্ত-অবসন্ন অবয়ব দেখলে আমার তা-ই মনে হয়। ভোর থেকে দুপুর, বিকাল থেকে সন্ধ্যা আবার রাত থেতে সকাল এই শহরে প্রসন্ন চেহারার মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া ভার। যেখানেই যার মুখের দিকে তাকাই; কেবল তাড়াখাওয়া, ছুটে চলা বিষণ্ণ ধাবমান এক মানুষ।
তিন.
তোর পরিণতিটা কী? ওই যে শেষ পর্যন্ত ‘একটুখানি খবর’ হয়ে যাওয়া। এই শহরে ‘পাবলিক বাস’ থাকবে না। শত শত বেনিয়া খেয়ালখুশি মতো বাস নামাবে। কোনো গাড়ি নিয়ম মেনে চলবে না। শহর কর্তৃপক্ষ দায়সারা বাসস্টপেজ করে দিলেও সেই খানে বাস থামবে না। পুলিশের গোফেরডগায় আইন ভাঙবে গাড়িচালক, ফুটপাতে তুলে দেবে মোটর সাইকেল, অযথা হর্ন বাজিয়ে বধির করে দেবে মানুষকে, তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। এক নগরে দুটি কর্পোরেশন, মানে দুজন নগর পিতা, তারপরও শহরজুড়ে ধুলো। এক মেয়র ঝাড়–হাতে নগর পরিষ্কারের মহড়া করলেন গ্রিনিচ বুকে নাম তোলার তাড়ায়! মাত্র বৈশাখ চলছে। বাঙলা পঞ্জিকার নিয়মে গ্রীষ্মের পর বর্ষাকাল। কিন্তু গ্রীষ্মেই ঝড় এবং প্রতিদিনের বৃষ্টি জানান দিচ্ছে এবার ঢাকা শহরের জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। সবখানে খোঁড়াখুঁড়ি সেই সাথে দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা- অতএব যদি হয় টানাবৃষ্টি তাহলে ঢাকা ডুবতে কতক্ষণ!
এতো এতো অনিয়ম, অসঙ্গতির মধ্যে এই শহরের সড়কে সড়কে প্রতিদিনের প্রাণহানি, মানুষের অঙ্গহানি নতুন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। দুই বাসের চাপায় পড়ে প্রথমে হাত গেলো, তারপর প্রাণ। কলেজ ছাত্রের এমন পরিণতি নিয়ে কদিন আদালতপাড়া এবং সারাদেশে বেশ তোলপাড় হলো। সেই তোলপাড়ের মধ্যেই আরও অনেকগুলো ঘটনা ঘটতেই থাকলো। এখনো থামলো না ‘পাসের পাল্লা’। থামবে বলে মনেও হয় না; কেন না এই শহরের পরিবহণ খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারে কেউ আছেন আর থাকলেও তার ক্ষমতা আছে এটা এখন আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
তাই, এই বিপদসংকুল শহরে নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিয়েই চলতে হয় সবাইকে। অতএব চলার পথে, একটু তাড়া কমিয়ে, হাতে একটু সময় নিয়ে সাবধানে ধাবমান হওয়া কী বাঞ্ছনীয় নয়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)