বিবিধ কারণেই ‘মিরপুর’ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন ‘মিরপুরে’র প্রতিটি ধূলিকণায় অশ্রুবিন্দু আর হাহাকারের যে অব্যক্ত সংশ্লেষ, তা বহুলাংশে অনালোকিত! সংখ্যাহীন স্বজনের করোটির ওপর দাঁড়ানো মিরপুরের সারি সারি বহুতল ভবনগুলো এখানকার ‘বধ্যভূমি’র দম বন্ধ হওয়া গুমোট অন্ধকারকে ঢেকে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কান পাতলে এর জঠরে শোনা যায় অগণিত মৃতের অবিশ্রান্ত ক্রন্দন! বস্তুত, একাত্তরের ‘মীরপুর’ ছিল বর্বরতা আর পশুত্বের এক সদম্ভ উল্লাস-মঞ্চ! পশু জবাইয়ের স্থানকে যদি ‘কসাইখানা’ বলা হয়, তবে একাত্তরের মিরপুর ছিল তেমনই এক মৃত্যুমঞ্চ।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান ‘শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি’ দেখে এসে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন, “কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন্ পাশবিকতার উল্লাস? সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকতো, এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ, তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না। আর মানুষ কেন, কোন প্রাণীই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?”
প্রশ্ন জাগে মনে, এতটা বোধহীন বর্বরতার কাজ কারা সেদিন করেছিল? কাদের হাতে রঞ্জিত হয়েছিল মিরপুরের সবুজ মাটি? শুধুই কি পাকিস্তান সেনাবাহিনী? হ্যাঁ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীই ছিল এই হত্যাযজ্ঞের ‘মাস্টারমাইন্ড’। তবে এ অপরাধের সাথে তারা যুক্ত করে নিয়েছিল এদেশে আশ্রিত অবাঙালি বিহারি জনগোষ্ঠির সুবিধাবাদী অংশ এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামীসহ এর অঙ্গ-সংগঠন ও অনুরূপ ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের। উনিশশো একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও, ঢাকার অদূরে ‘মিরপুর’ তখনও ছিল শক্রকবলিত এক দুর্গ! বিহারি রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় এখানে সাধারণ পোষাকে আত্মগোপন করে ছিল বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্য।
এ প্রসঙ্গে মিরপুর রণাঙ্গনের কোম্পানি কমান্ডার মে. জে. (অব) হেলাল মোরশেদ (বীর বিক্রম) বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের সাহায্য করার জন্য ইস্ট পাকিস্তান সিভিলিং বলে একটি বাহিনী গঠন করেছিল, যার সদস্য ছিল তৎকালীন বিহারি জনগোষ্ঠীর থেকে নেয়া আর এদের সঙ্গে রাজাকার-আলবদর বাহিনী তো ছিলই। এলাকাটিকে বলতে গেলে ছোটখাট পাকিস্তানের ঘাঁটি বলেই বলা যেত, এমনকি ওদের বাড়িতে পাকিস্তানের ফ্লাগ উড়ছে।” প্রায় ২০ হাজার সশস্ত্র বিহারি সদস্যের এই বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-সহযোগী হিসেবে বাঙালি নিধনে লিপ্ত ছিল। এদের হাতেই মিরপুর ‘কসাইখানা’য় পরিণত হয়েছিল। মিরপুরের ‘জল্লাদখানা’ এমনি এক বধ্যভূমি, যেখানে দৈনিক গণহারে মানুষ জবাই হতো! ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’র তথ্যে ঢাকার ৭০টি বধ্যভূমির মধ্যে মিরপুরেই সর্বাধিক ২৩টি বধ্যভূমির অস্তিত্ব রয়েছে, যার মধ্যে ১০টি ব্যাপক গণহত্যার ক্ষতচিহ্ন বহন করে!
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য মতে, মিরপুরে প্রথম গণহত্যার শিকার হন কবি মেহেরুননেসা ও তার পরিবার। এরপর মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ন’ মাস প্রায় লক্ষাধিক বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মিরপুরের অলি-গলি-মেঠোপথ। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম, এসপি লোদী ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার নৃশংস মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ বর্বরতার ইতি ঘটে। ৩১ জানুয়ারি ‘মিরপুর’ শত্রুমুক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু মিরপুরের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করতে সময় ব্যয় হয়েছে আরও অতিরিক্ত ১০দিন অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত!
ঢাকার মিরপুর-মোহাম্মদপুর ও পুরান ঢাকার কিছু মহল্লা ছিল বিহারি ও উর্দুভাষী অধ্যুষিত এলাকা। এর মধ্যে মিরপুরে থাকতো ছোট ব্যবসায়ীসহ মাংস ব্যবসায়ীরা এবং রেলওয়ে, টিঅ্যান্ডটি ও বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। মোহাম্মদপুরে থাকতো বড় ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত চাকরীজীবীরা। এছাড়া চট্টগ্রাম, নীলফামারী, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুরসহ আরও কিছু জেলায় বিহারিদের দাপট ছিল অত্যাধিক। অথচ এদের পূর্বপুরুষরা একসময় রিক্ত হস্তে এ দেশে আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে কিংবা বাংলাদেশের মানুষকে এরা কোনোদিনই হৃদয়ে স্থান দেয়নি। বরং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালিদের প্রতি এদের আচরণ ছিল বিমাতাসুলভ এবং ক্ষেত্র বিশেষে সুযোগসন্ধানী হন্তারকের।
‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে’র ট্রাস্টি মফিদুল হকের মতে, এই মিরপুরে “গড়ে তোলা হয় রিফিউজি টাউনশিপ, যে ধরনের বসতি পাঞ্জাব পার্টিশনের ভিকটিমদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিম ভারতে অনেক গড়ে উঠেছিল। মিরপুর-মোহাম্মদপুরে সরকারি উদ্যোগে যে কলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে পাকিস্তানি বাঙালি-বিদ্বেষ নীতির চরম প্রকাশ ঘটিয়ে অবাঙালি মোহাজেরদের দেয়া হয় অগ্রাধিকার। উদ্দেশ্য ছিল এভাবে ঢাকা শহরে একটি বিশাল তাবেদার গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মদদদাতা হিসেবে কাজ করবে।” প্রকৃতপক্ষে বিহারিদের পাকিস্তান-ঘেঁষা তাবেদারি চরিত্র পূর্ণতা লাভ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। লুটপাট, ধর্ষণ আর গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এদের অধিকাংশ। এই বিহারিদের দ্বারাই মিরপুর ৬নং সেকশনের কাঁচা-বাজারটি লুণ্ঠিত মালামাল বেচাকেনার বাজারে পরিণত হয়েছিল। যদিও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তক্ষেপে পরবর্তীতে এ বাজারটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই মিরপুর-মোহাম্মপুর ছিল শাসক পাকিস্তানিদের কাছে বিশ্বস্ত এক রাজত্বের নাম। আর এ রাজত্বের তাবেদার ছিল এখানকার বিহারিরা। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় নেতৃস্থানীয় বিহারিরা মিরপুরে বিপুল অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলে। একে মিনি-ক্যান্টনমেন্টের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের শেষাংশে এসে দেশের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সশস্ত্র বিহারিরাও মিরপুরে এসে আশ্রয় নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকার রেসকোর্সে আত্মসমপর্ণ করে, কিন্তু মিরপুরের সশস্ত্র বিহারিরা আত্মসমর্পণের বাইরেই রয়ে যায়। ফলে মিরপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো (যেমন মামা গ্রুপ, বাবর গ্রুপ, তৈয়বুর গ্রুপ, হানিফ গ্রুপ ও বিএলএফ গ্র“পের মুক্তিযোদ্ধারা) কয়েক দফা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে মিরপুরকে শক্রমুক্ত করতে উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়। এরপর বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মিরপুরে সামরিক হস্তক্ষেপের। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে এ অভিযান শুরুতেই মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। অভিযানে অংশ নেয়া ৪২ জন সেনাসদস্য ও প্রায় ৮০ জন পুলিশসদস্য কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই নিহত হন। অসম প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাকি যোদ্ধাদের শেষ পর্যন্ত পিছু হটে প্রাণরক্ষা করতে হয়।
মিরপুর রণাঙ্গনে সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন অধিনায়ক মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী (পরবর্তীতে ‘মেজর জেনারেল’ ও ‘বীর বিক্রম’) এ অভিযানের ‘আদেশ’ সম্পর্কে তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “২৮ জানুয়ারি দুপুরের দিকে জেনারেল ওসমানী ও শফিউল্লাহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার হেডকোয়ার্টারে আসেন। ওসমানী আমাকে বলেন, বিহারি, রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের জন্য বাংলাদেশ পুলিশবাহিনী মিরপুর ১২নং সেকশনে যাবে। পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীদের একটা লিস্টও তারা তৈরি করেছে। তিনি পুলিশকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আমাকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন। তিনি আমাকে আরও বলেন, এক কোম্পানি সৈন্য যেন আগামীকালের (২৯ জানুয়ারী) মধ্যেই মিরপুর যায়। সেখানে গেলে পুলিশ ও ভারতীয় সৈন্যরা এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বিস্তারিত জানাবে এবং পরদিন ৩০ তারিখ ১২নং সেকশনে গিয়ে পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। … আমি মিরপুরের সার্বিক অবস্থা জানার জন্য ওসমানীর কাছে দু’একদিন সময় চাই। তিনি এতে বিরক্ত হন এবং বলেন, ওখানে গিয়েই তোমার অফিসাররা খোঁজখবর করুক। তিনি তাড়াতাড়ি করে সৈন্য পাঠাতে আদেশ দেন। তার আদেশে আমি তৎকালীন ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খানকে তার কোম্পানির সৈন্যদের নিয়ে ২৯ জানুয়ারি মিরপুর যেতে আদেশ দিই।’
মিরপুরে সেনা অভিযান সম্পর্কে মে. জে. (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, “আদেশ প্রাপ্তির পর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও রেওয়াজ মোতাবেক সম্ভাব্য অপারেশনাল এলাকা পর্যবেক্ষণ তথা রিকনাইসেন্স (ইংরেজি সংক্ষিপ্ত শব্দ হলো ‘রেকি’) করার কোনো সুযোগ আমরা পেলাম না। আদেশ প্রাপ্তি থেকে নিয়ে মিরপুর এলাকায় অপারেশন শুরু করা পর্যন্ত সময়ের তফাত ছিল ৪৮ ঘণ্টার কম। পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী, প্রস্তুতি ছিল অপর্যাপ্ত।”
ওই সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আরও জানান, “তখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাঠামো ‘তরল’ পর্যায়ের।” এছাড়া তখন ঢাকা সেনানিবাসে আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য এবং ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করায়, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অস্থায়ীভাবে প্রায় দু’মাস রমনা রেসকোর্সের উত্তর-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ শাহবাগ মোড়ের কাছে অবস্থান নিতে হয়। যাহোক, মিরপুরে পুলিশ বাহিনীকে সেনা-সহায়তা দেয়ার আদেশ পেয়ে অধিনায়ক মেজর মঈনুল মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছাকাছি এলাকায় একটি খালি বাড়িতে মাত্র পাঁচ-ছয়জন সৈনিককে নিয়ে ব্যাটালিয়নের অগ্রবর্তী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে তল্লাশি ও নিরস্ত্রীকরণ অভিযান শুরু করেন।
মিরপুর নিরস্ত্রীকরণ অভিযানের মূল অধিনায়ক মে. জে. (অব.) কে এম শফিউল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “১৬ ডিসেম্বরের পর মিরপুরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ভারতের বিহার রেজিমেন্ট। ৩০ তারিখ তারা মিরপুর থেকে চলে যাওয়ার পর মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে সেকেন্ড বেঙ্গল ও ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের নেতৃত্বে ফোর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিরপুরে অভিযান চালায়। প্রথমে পুলিশ মিরপুর ১২ নম্বর সেক্টরের বিহারিদের নিরস্ত্র করতে যায়। সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সেনা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু বিহারিরা তাদের ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। পরে অন্য সেনারা বিহারিদের নিরস্ত্র করে। এই অভিযানে পুলিশের এসপি লোদী, সেনাবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট সেলিমসহ ৮০ থেকে ৯০ জন শহীদ হন। ৩১ জানুয়ারি এক হাজারেরও বেশি বিহারি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তী সাত দিনে মিরপুরের বিহারি কলোনিগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল দুই-তিন ট্রাক রাইফেল, মর্টার, অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন ইত্যাদি।”
বস্তুত, মিরপুরে পরিচালিত এ অভিযানটি ছিল অনেকটা আত্মঘাতী মিশনের মতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘মিরপুরের অবাঙালি প্রতিরোধের তেমন কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না এবং আত্মসমর্পণ না করে সশস্ত্র বিহারিদের কোনো উপায়ও ছিল না।’ ভারতীয়দের মতো বাঙালিদেরও সময়ক্ষেপনের কৌশল ব্যবহার করার সুযোগ ও পরিবেশ দুই-ই ছিল। কিন্তু তা না করে তড়িঘড়ি মিরপুরে অভিযান চালানোর মাসুল গুণতে হয়েছে অনেক চড়া মূল্যে। যদিও ৩১ জানুয়ারি সকালে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ দুটি রেজিমেন্টের সহায়তায় মিরপুর শত্রুমুক্ত হয়েছিল, কিন্তু মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেদিন কোনো বিহারি পুরুষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৩০ জানুয়ারি রাতেই বিহারি ঘাতকরা পার্শ্ববর্তী নদীবেষ্টিত এলাকা পার হয়ে সরে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২০ হাজার সশস্ত্র বিহারির অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে, যাদেরকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় আনা কিংবা কৃত অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মুক্তিযুদ্ধের আগে মিরপুরের পল্লবীতে বসবাস করতেন। সাংবাদিক মিরাজ মিজুর ‘মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি’ বইয়ের ভূমিকায় অধ্যাপক মামুন লিখেছেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এরকম অবরুদ্ধ ছিলাম পল্লবীতে। নিজের চোখে দেখেছি অবাঙালিদের হত্যাযজ্ঞ। অবাঙালি পরিবারের সহায়তার কারণে প্রাণে বাঁচি। যেদিন পল্লবী ছেড়ে চলে আসি, তখন রাস্তার পাশে দু’একটি লাশ যে পড়ে থাকতে দেখিনি তা নয়। আমরা ঢাকার অবস্থা তখনও জানতাম না। মিরপুরের সেদিনগুলির কথা আমি মনে আনতে চাই না। তবে, মিরপুরের ঘটনাবলি মনে এমন একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো যে, স্বাধীনতার পর দু’দশক সেখানে পা দিইনি। এখনও মিরপুর যেতে আমার ভালো লাগে না।”
ষাটের দশকের মধ্য ভাগ থেকে বাঙালি-বিহারি বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বাঙালি বিরোধী দাঙ্গা বাধে। এ দাঙ্গা দমনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে বিহারিরা মিরপুরে বাঙালি প্রার্থীর নির্বাচনী কাজে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনে মিরপুর-মোহাম্মপুর ও তেজগাঁও আসন থেকে জামাতের প্রার্থী হয় গোলাম আযম আর তার নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্ব পায় তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা কাদের মোল্লা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডাঃ মোশাররফ গোলাম আযমকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। নৌকার জয় বিহারিদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। ৭ মার্চের পর থেকে মিরপুর এ কারণে রক্তাক্ত হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ মিরপুর বাংলা স্কুলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ঘটনায় বিহারিদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাইয়ুম। প্রখ্যাত সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব আহত শিক্ষককে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রাণ বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়ায়, তিনিও বিহারিদের চক্ষুশূল হন। ২৯ মার্চ বিহারি অধ্যুষিত মিরপুর থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। ২৭ মার্চ মিরপুর ৬ নং সেকশনের ‘ডি’ ব্লকের বাড়িতে কবি মেহেরুননেসাকে সপরিবারে খুন করে বিহারিরা। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই মিরপুর-গাবতলী সড়কে যাতায়াতকারী যানবাহনগুলোর যাত্রীরা লুষ্ঠন ও গণহত্যার শিকার হয়েছে বিহারিদের হাতে। এদের অধিকাংশেরই দেহাবশেষ ফেলা হতো মিরপুরস্থ আমিনবাজারের তুরাগ নদীর লোহার পুলের নিচে কিংবা ম্যানহোল, ড্রেন, কুয়া, ডোবা অথবা অগভীর জলাশয়ে।
সমগ্র ন’ মাস জুড়ে মিরপুরে সংখ্যাহীন ‘গণহত্যা’র উৎসব চলেছে! ঢাকার যেসব স্থানে লাশ লুকানোর জায়গা ছিল না, সেসব স্থানের লাশ রাতের বেলায় ট্রাক, জিপ বা মাইক্রোবাসে করে মিরপুরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এনে মাটিচাপা দেয়া হতো। যুদ্ধের শেষ দিকে মিরপুরের চিড়িয়াখানামুখী সড়কের পূর্ব প্রান্ত থেকে একদল হাজীকে বহন করা একটি মাইক্রোবাস শিয়ালবাড়ির প্রবেশমুখের কাছে এনে হাজীদের সবাইকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে ‘রূপনগরে’র (‘শিয়ালবাড়ি’র বর্তমান নাম) প্রবেশমুখের ডানদিকে ‘হাজি রোড’ নামের সড়কটি সেই পৈশাচিক ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি ধরে রেখেছে। যদিও মিরপুরের ‘শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি’ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ছিল সবচেয়ে আলোচিত নাম, কিন্তু এর কোন দৃষ্টিগ্রাহ্য নিদর্শন বর্তমানে সংরক্ষিত নেই। এ বধ্যভূমির মাত্র কয়েক শতাংশ জায়গা ‘স্থানীয়’ দাবীদার এক পরিবারের দখলে থাকা পারিবারিক গোরস্থান হিসেবে এখনও টিকে আছে। এটিকে সরকারীভাবে অধিগ্রহণ করে ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’র মত আবহ সৃষ্টি করলে, শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব রক্ষা পাবে। অন্যথায় সময়ের সাথে সাথে পারিবারিক এই গোরস্থানও একদিন বহুতল ভবনে পরিণত হবে।
‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের প্রাক্তন ভোকাল সংগীত-তারকা মাকসুদুল হকের পরিবার একাত্তরের বৈরী পরিবেশে মিরপুরের পল্লবীতে অলৈাকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। বেঁচে যাওয়ার সে গল্প তিনি ইন্টারনেটকেন্দ্রিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। এখন আর সেটা নেটে পাওয়া যায় না। তবে গুগলে ইংরেজিতে শুধু ‘মিরপুর’ লিখে সার্চ দিলে, পাকিস্তানের এক ‘মিরপুর’ দৃশ্যমান হয়! ‘ঢাকা-মিরপুর’ বা ‘মিরপুর-ঢাকা’ লিখে সার্চ দিলেই শুধু আমাদের এই ভালোলাগা-মন্দলাগার ‘মিরপুর’ দেখা দেয়। কুষ্টিয়া এবং ঢাকার ‘মিরপুরে’র মতো হয়তো এমন আরও অসংখ্য মিরপুর আছে, যা এখনও অনালোকিত। সবকিছু ছাপিয়ে ‘মিরপুরে’র স্বকীয়তার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রূপটি হয়তো শিল্পী মাকসুদুল হকের চোখেই ধরা পড়েছে। তার মতে, “মিরপুর এক আতঙ্কের নাম। আমাদের চারটা আলাদা ‘থানা’ আছে। কারণ, মিরপুরের চেয়ে বেশি টাউট-বাটপার, চোর-ছ্যাঁচড়, ডাকাত, খুনি, জঙ্গি ইত্যাদি বাংলাদেশে আর কোথাও নেই! মিরপুর একটা ডেজিগ্নেইটেড ক্রাইম জোন এবং তা বহাল তবিয়তে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আছে। অপর দিকে মিরপুর সুফিসাধক শাহ আলী বোগদাদীর পবিত্র ভুমি। এখানে মাজার শরিফ আছে, মসজিদ আছে, সনাতন মন্দির আছে, বৌদ্ধবিহার আছে, গির্জা আছে, মাদ্রাসা আছে, আশ্রম আছে, আখড়া আছে, হিজাব আছে, নিকাব আছে, দাড়ি আছে, টুপি আছে, গামছা আছে, পাগড়ি আছে। নাস্তিক আছে, আস্তিক আছে, তৃতীয় লিঙ্গ আছে, সেক্স ওয়ার্কার আছে, বিহারি আছে, বাঙালি তো আছেই, চাকমা আছে, মারমা আছে, আছে তিনটি অসমিয়া পরিবার এবং আছে বহু বিদেশি।”
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘মিরপুর’ দাবি করে ‘আলাদা অধ্যায়’ আর ‘বিশেষ মূল্যায়ন’! কিন্তু প্রতিবছর ‘৩১ জানুয়ারি’ এলে নামকাওয়াস্তে পালিত হয় ‘মিরপুরের বিজয় দিবস’! স্মৃতির গহন থেকে উঁকি দেয় হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো! ব্যস, এটুকুই! দিন ফুরোলেই সবকিছু আবার সেই আগের মতো। না মেলা হিসেবগুলো মেলায় না কেউ কখনই! এভাবেই কি চলবে বছরের পর বছর?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)