বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মহোদয় প্রকাশকদের সবক দিলেন উস্কানিমূলক লেখা না ছাপতে, আর লেখকদের সবক দিলেন উস্কানিমূলক লেখা না লিখতে। অথচ এই বইমেলাকে আমাদের প্রজন্ম দেখেছে প্রাণের উৎসব হিসেবেই। ছাত্রজীবনের সীমিত সামর্থ্য সম্বল করেই প্রতিবছর ঢাকা ছুটে যেতাম সেই প্রাণের মেলায় অংশ নিতে। সেটা সেলফির যুগ ছিলো না।ছিলো অটোগ্রাফের যুগ।
মনে পড়ে, ধাক্কাধাক্কি করে নতুন বই কিনে লেখককুঞ্জে দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ নিতে। ফি সন ছুটে যেতাম ঢাকা, এর অমোঘ আকর্ষণে। এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে জীবন আর জীবিকার ঘেরাটোপে আটকে সেই উত্তেজনা অনেকখানিই প্রশমিত। বই পড়ার নেশা এখনো পুরোদমে থাকলেও ইচ্ছে থাকলেও আর ছুটে যেতে পারি না রাজধানীতে। অনলাইনে কারিগর বা রকমারী, আর চট্টগ্রামের বাতিঘর থেকেই সংগ্রহ করি পছন্দের বইগুলো।
তারপরেও ফেব্রুয়ারি আসলেই মনটা কেন জানি আকূল হয়ে ওঠে প্রাণের মেলায় ছুটে যেতে। বইমেলা তাই মিলনমেলা, প্রাণের মেলা, ভালোবাসার মেলা। কিন্ত বইমেলা কি এখনো সেই প্রাণের মেলাই আছে? ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা প্রথম কালিমালিপ্ত করে বইমেলাকে। অতি অনুভূতিশীলদের চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে রাজপথে পড়ে থাকেন তিনি। সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলেও এই আঘাতই তাঁকে মৃত্যুর পথে টেনে নেয়। থেমে যায় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার কলমটি। শুরু হয় বইমেলাকে কেন্দ্র করে নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার।
এদেশের প্রকাশনা শিল্পের বিরুদ্ধে রীতিমতো কোমড় বেঁধে নামে একটি চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। অনলাইন, অফলাইনে নানা ধরণের নেতিবাচক প্রচারণা চলতে থাকে প্রগতিশীল লেখক আর ব্লগারদের বিরুদ্ধে। বিশেষ কর গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর প্রায় দিশেহারা একটি মহল তখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তচিন্তার কন্ঠরোধ করতে। গতবছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের বইমেলাতে দুটি বড় মাপের দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। প্রথমে হেফাজতের হুমকির মুখে মেলা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল আর নিষিদ্ধ করে আবুল কাশেম এবং সৈকত চৌধুরী অনুদিত “নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর” বইটি।
সবচেয়ে বিয়োগাত্মক ঘটনাটি ঘটে গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি। বইমেলা থেকে ফেরার পথে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা বাংলা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে। গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী। প্রাণের মেলা পরিণত হয় শোকের মেলায়। ৩০ সেপ্টেম্বর একই সাথে হামলা হয় দুটি প্রকাশনা সংস্থায়। নিহত হন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল দীপন। শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী টুটুল এবং দুজন অনলাইন এক্টিভিস্টকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে তারা। ফলে স্বভাবিকভাবেই এবারের বইমেলা কেন্দ্র করে জন্ম নেয় ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
প্রথমে লেখক আর তার পরে প্রকাশকদের উপর এই হামলাগুলোর কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় এক ধরণের চাপা শংকা বিরাজ করছে লেখক আর প্রকাশকদের মধ্যে। ভিন্ন ধারার বইগুলো ছাপানোর ব্যাপারে ব্যাপক অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে প্রকাশকদের মধ্যে। ফলে বিপাকে পড়ে গেছেন লেখকেরা। বিশেষতঃ সেই সব লেখকেরা যারা অনলাইন এক্টিভিজমের সাথে জড়িত। কিছুদিন আগে আমার এক শ্রদ্ধেয় সিনিয়র এক্টিভিস্ট-এর কাছে শুনতে পেলাম, একটি বই প্রকাশের ব্যাপারে তিনি অনেক প্রকাশকের কাছেই ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু, সবজায়গায় বইয়ের বিষয়বস্তুর জিজ্ঞেস করার বদলে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে লেখক ব্লগার বা অনলাইন এক্টিভিস্ট কিনা।
ইতিবাচক উত্তর দিতেই সবাই পিছিয়ে গেছেন সাথে সাথে। কারণ একটাই, আতঙ্ক। এই যখন অবস্থা, ঠিক সেই সময়েই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সাহেব এবার বললেল “উস্কানি”র কথা। উস্কানি জিনিসটা আসলে আপেক্ষিক। কারণ তার সার্বজনীন মানদণ্ড কখনো থাকতে পারে না।একজনের কাছে যা উস্কানিমূলক, আরেকজনের তাই চির আরাধ্য। যুগে যুগে অনেক লেখকই কথিত মতে উস্কানি দিয়েছেন। আর সেই উস্কানি ভেঙে ফেলেছে সকল অচলায়তের বেড়াজাল। বিসর্জন নাটকে কবিগুরু দিয়েছেন উস্কানি, অগ্নিবীণা-বিষের বাঁশীতে নজরুল দিয়েছেন উস্কানি, উস্কানি দিয়েছেন “পথের দাবী”তে শরত, দিয়েছেন প্রবীর ঘোষ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ শরীফসহ বরেণ্য অনেক লেখক।
তাঁদের দেয়া উস্কানিতে ঊদিত হয়েছে নতুন সূর্য। হারিয়ে গেছে অন্ধকার। তাহলে কিসের ভিত্তিতে করা যাবে এই তথাকথিত উস্কানির মাননির্ধারণ? অভিজিৎ রায়ের “বিশ্বাসের ভাইরাস”, বা আলী দস্তির “নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর” যেমন কারো কাছে উস্কানিমূলক মনে হয়, ঠিক তেমনি লজ্জাতুন্নেছা তাবিজের কিতাবও কারো কারো কাছে উস্কানিমূলক মনে হতে পারে বৈকি।
একইভাবে মাও সে তুং এর রেডবুক, বা হফনারের প্লেবয় পত্রিকাও তো উস্কানিমূলক আরব্য রজনী বা বাতসায়নের কামসূত্রের মতো। তাহলে কী হবে সেই উস্কানির ষ্ট্যাণ্ডার্ড? চাপাতি আর ৫৭ ধারা ইতিমধ্যেই চেপে ধরেছে অনলাইন এক্টিভিস্টদের কন্ঠ। এখন ছাপা বইয়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের প্রাক্কালে মহাপরিচালক মহোদয় দিলেন উস্কানি থিউরি।
আসলে ঘুরেফিরে মুক্তচিন্তার আর প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা। লেখকের কলমকে আটকে রেখে কোনোদিন শৈল্পিক সৃষ্টিকর্ম প্রত্যাশা করা সমীচিন নয়। আস্তিকতা, নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা,বদ্ধচিন্তা, সাহিত্য, নারীবাদ, পর্নোসাহিত্য সবকিছু লেখার বা প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। গ্রহণ বা বর্জনের বিচারক পাঠক ব্যতীত আর কেউ তো হতে পারেন না। তারাই নির্ধারণ করবেন কোনটি উস্কানিমূলক আর কোনটি মাস্টারপিস।
জাতির মনন গড়তে হলে, আলোকিত মানুষ পেতে হলে এই বিধিনিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন যে করতেই হবে। তবেই গড়ে উঠবেএকটি সত্যিকারের আধুনিক যুক্তিবাদী প্রজন্ম। যুক্তির আকাশে উড়বে মুক্তির বারতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)