তখনও বিকেল পুরোপুরি উধাও হয়ে যায় নি। তবে যাই-যাই করছিল। ঠিক সেই সময়ে গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা খেলার মাঠ থেকে দল বেঁধে ঘরে ফিরছিলাম আমরা। অন্যান্য দিন এদিকটায় লোকজনের বেশ দেখা মেলে। রিকশা, সাইকেলের টুংটাং, ফেরিওয়ালার বাজখাই গলা, রাস্তার পাশের হোটেল কিংবা সেলুন থেকে চড়া সুরের সিনেমার গান আর বাড়ির রকে বসে থাকা আড্ডাবাজদের হাসি তামাশার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। কিন্তু আজ কেমন যেন সব কিছুই কম-কম লাগছে।
আমরা যখন বাড়ির দিকে ফিরছি তখন ইলেকট্রিকের খাম্বা, বাড়িঘরের ছাদ , কার্নিশ , দরজা- জানালা বেয়ে একটু একটু করে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে চারদিকে।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ইঁচড়ে পাকা বলে খ্যাতি আছে লিটনের। এলাকাতে সে ইঁচড়ে পাকা লিটন হিসেবে নিজের শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে। বন্ধুমহলে লিটনকে এই নামেই ডাকা হয়। অবশ্য মান সম্মানের একটা ব্যাপার থাকায় আমরা বন্ধুরা ওকে সবার সামনে ইঁচড়ে পাকা লিটন বলে পারতপক্ষে সম্বোধন করি না। আর সবার সামনে এই নামে ডাকলে কি কারও মান-সম্মান থাকে! তাই আমরা কায়দা করে লিটনকে ‘ইপালি’ বলে ডাকি।
ইপালি নামটা কে দিল, কেমন করে এলো কিংবা ইপালি নামকরনের সার্থকতাই বা কোথায়- এসব নিয়ে এলাকায় রয়েছে নানা কাহিনি, কেচ্ছা। আমাদের কি ওতসব দেখলে চলে!
এলাকার ছোটরা যেদিন প্রকাশ্যে লিটনকে ইপালি ভাই, ইপালি ভাই বলে ডাকতে শুরু করল সেদিন লিটন প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ছোটরা ইপালি ভাই বলে কাকে ডাকছে। বার দু’য়েক ভালো করে খেয়াল করার পর তার অন্তরাত্মা ছ্যাঁত করে উঠল।
আরে! ছোটরা তো তার দিকে তাকিয়ে তাকেই ইপালি ভাই-ইপালি ভাই বলে ডাকছে।
ইপালি ভাই! বলে কি!
লিটনের বাবা-মা তাদের অতি আদরের পুত্রধনের জন্য কাপ্তানবাজার থেকে বেছে বেছে কালো রঙের তিন-তিনটে খাসি আনিয়ে মহল্লার মানুষজনকে খাইয়ে-দাইয়ে আকিকা করে নাম রেখেছেন লিটন, আর এরা কিনা সেই নামটাকেই পাল্টে দিয়েছে!
‘এই নাম কে তোদের শিখিয়ে দিয়েছে?’
‘শিবলি ভাই।’
শিবলি ভাই দিয়েছে এই নাম! এও কি সম্ভব?
শিবলি ভাইকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। শুধু এই তল্লাটে না, আশেপাশের তল্লাটেও সে ভয়ংকর এক নাম। গাল-কাটা শিবলি ভাই বলেও কেউ কেউ তাকে ডাকে। শিবলি ভাই লিটনের মামাত ভাই চন্দনের বাচপান কি দোস্ত। চন্দন ভাই বাসায় এলে মাঝে মধ্যে লিটনকে এটা সেটা নিয়ে খ্যাপায়। কে জানে চন্দন ভাই আবার শিবলি ভাইকে দিয়ে কোনো রকমের গিরিঙ্গি চাল চালল কিনা! চন্দন ভাইয়ের অপর কোনো বিশ্বাস নেই। কখন যে কি করে বসে! হাসতে হাসতে সিরিয়াস দুষ্টুমি করতে সে ওস্তাদ।
শিবলি ভাই কি ছোটদের দিয়ে স্রেফ মজা করার জন্য ইপালি নাম দিল কিনা! লিটন ওদের কিছু বলল না পাছে তার এই নাম জানাজানি হয়ে যায়! সে চুপ করে থাকল। এই না বলাটাই পরবর্তীতে ওর জন্য কাল হয়ে তাল থেকে তিল হয়ে বন্ধুমহলেও ছড়িয়ে পড়ল। এখন মহল্লার সবাই লিটনকে নিষ্ঠার সঙ্গে এই নামে ডাকে।
একদিন দুপুরবেলায় লিটন বড় রাস্তার ওদিকটায় দাঁড়িয়েছিল। একজন আগন্তুক ওদের মহল্লায় একজনের কাছে জানতে চাইল,
‘ভাই, রিয়াজউদ্দিন উকিল সাহেবের বাড়িটা কোনদিকে?’
‘এখান থেকে একটু সামনে গেলে ডাইন দিকের শেষ মাথায় দোতলা যে বাড়িটা দেখতাছেন সেইটা হইল ইপালিগো বাড়ি। ঐ বাড়ির উল্টা দিকেই হইল উকিল সাহেবের বাড়ি।’
আগন্তুক লোকটা দিক নির্দেশনা পেয়ে অবাক হয়ে হাঁটা শুরু করল আর তা দেখে লিটনের মেজাজটাই গেল বিগড়ে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করল, না, এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। আজই বাবাকে বলে এই মহল্লা ছেড়ে অন্য মহল্লায় চলে যেতে হবে।