সানী ভাইকে নিয়ে কী লিখব। একহাজার পৃষ্ঠা লিখলেও লেখা শেষ হবে না। এক পাতা লিখলে হয়তো সমাপ্ত হয়ে যাবে সানী ভাইয়ের কীর্তিকাহিনী।
সানী ভাইয়ের বহু পরিচয়। তিনি কবি। তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ছড়াকার। তিনি ঢাকাইয়া সমাজের প্রতিনিধি। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত। তিনি বঙ্গবন্ধু সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ে আপোষহীন।
এরকম অনেক পরিচয়ে তাকে মহিমান্বিত করা যায়। তিনি সকলের প্রিয় সদাহাস্য সদারসিক কবি আসলাম সানী। সানী ভাইয়ের মুখে সবসময় রঙিন হাসি। সবাইকে প্রাণখুলে হাসাচ্ছেন। মন খুলে কথা বলছেন।
যেন উচ্ছ্বসিত ঝর্ণাধারা। যেখানে সানী ভাই সেখানেই আনন্দের উৎস। তার সামনে কেউ গোমড়ামুখো থাকতে পারবে না। হাসতে হবেই তাকে। শ্লীল-অশ্লীল, ছোট বড় কোনো ভেদাভেদ নেই। ছেলেমেয়েদের সামনে শ্রাব্য-অশ্রাব্য বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অসঙ্কোচে। গালি তার মুখে মধুর হয়ে ওঠে। গালি তার মুখে সহজাত বুলি। নাতি-নাতনির সঙ্গেও তার একই রকম ব্যবহার। গালি দিয়ে তাদের সম্বোধন করবেন। আর সবসময় রসিকতা করবেন।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সানী ভাই আমার বড় ভাই। কবে কখন প্রথম দেখা সে সব মনে নাই। তবে আমরা ছোট হলেও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনোদিন ছোটোর মতো আচরণ করেননি। সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। সানী ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা শহরের এমাথা ও মাথা ঘুরে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। উদ্দেশ্যহীন অকারণ। সেই সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন, ঢাকা বিশেষজ্ঞ আনিস আহামেদ, চলচ্চিত্রকার জাহিদ হোসেন মনজু, আমি- আমরা সবাই লালবাগ, আমলিগোলা পাট্টি। একসাথে শৈশব- কৈশোর পার করেছি। সানী ভাইয়ের সঙ্গে এখনও আমার নিয়মিত সম্পর্ক রক্ষিত আছে। যোগাযোগ আছে।
সানী ভাই আমার অভিভাবক, আমার পিতৃতুল্য। আমার সুখ দুঃখের একান্ত সহচর। আমার সামান্য লোক হয়ে ওঠার পেছনে সানী ভাইয়ের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। আমাকে সকল বাঁধা বিঘ্ন থেকে তিনি পিতার মতো রক্ষা করে থাকেন। আমার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার উৎসাহদাতা সানী ভাই।
১৯৭৯ সাল। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ থেকে সংসদ নির্বাচন করেছিলাম। বাসা থেকে নিষেধ ছিল। শুধু সানী ভাইয়ের আগ্রহেই নির্বাচন করি এবং কামরুল-হাবিব পরিষদ থেকে বৈতরণী পার হই। ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনেও সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী হতে পারি সানী ভাইয়ের কল্যাণেই। পরাজিত হই তৎকালীন পরিবেশে। আমাদের আরেক সহযাত্রী ড. শাহাদৎ হোসেন নিপু। শেখ সাহেববাজার বাসী।
জীবনটা কত দ্রুতই না আমাদের ফুরিয়ে গেল। এই লেখা লিখতে গিয়ে কত স্মৃতিই না মনে পড়ছে। সানী ভাই ঘরে যেমন বাইরেও তেমন। ভাবীর সঙ্গে সবসময় ঠাট্টা-মশকরা করছেন। দুষ্টুমি করছেন।
মনে পড়ে ভাবী বললেন: যাও সানী, বাজার করো
সানী ভাই হাসতে হাসতে বললো: চলো তো টুলু, চলো, জলদি যাই। এগো লগে থাকলে আর লেখক হইতে পারুম না। যা দিন সব হান্দাইয়া ফালাইবো। এগো খিদা শেষ হইব না।
ভাবীও হাসছেন। সানী ভাইয়ের এই রসিক চরিত্র তারচেয়ে বেশি কে জানে! ভাবী পুরান ঢাকার বনেদী পরিবারের সন্তান। তাদের বিশাল আত্মীয়-গোষ্ঠী। সানী ভাইয়ের সকল অত্যাচার তিনি সমগ্র জীবন ধরে হাসিমুখে সহ্য করে গেলেন। কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি। সংসারের হাল ধরে সানী ভাইয়ের লেখালেখি করার জন্য সহায়তা করেছেন। তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মানুষ করেছেন। রুম্পা, শম্পা, ঝুম্পা। বড় দুজনের বিয়ে হয়েছে। ঝুম্পা এখন সানী ভাইয়ের সকল কাজের সহকারী। ছোট্ট একটা স্কুটি আছে শম্পার। বাবাকে একটানে কোথাও নামিয়ে দিয়ে আসছে। আবার বাসা ফেরার সময় সানী ভাইকে স্কুটির পেছনে বসিয়ে ঝুম্পা ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে।
অসম্ভব জীবনরসিক মানুষ আসলাম সানী। তার খাই খাই স্বভাব নাই। বেশি উচ্চাশা করেন না। পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছেন। সুখের সংসার। টাকার জন্য সানী ভাই কোনোদিন কাজ করেননি। ভালোবাসার টানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছেন। টিএসসি, শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমী- এসব স্থানেই নানা কাজে কর্মে সানী ভাইকে পাওয়া যাবে। সবার প্রিয় মানুষ। সবার হৃদয়েও তার ভালোবাসার আসন।
কেউ কখনও সানী ভাইকে কোনো কাজ না করেন না। সানী ভাই অন্যের জন্যও সারাক্ষণ ছুটে বেড়াচ্ছেন।
খুব পরোপকারী ও সমাজসেবক ধরনের ব্যক্তি তিনি। কোনো রোগী মানুষ যদি সানী ভাই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তবে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হবেই। প্রয়োজনে কারো চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌছে যাবেন। কারো চাকরি প্রয়োজন, কেউ জমি কিনতে চায়, কারো বিদেশ যাত্রা, কারো সন্তানের বিয়ে- সবার প্রতি সানী ভাইয়ের উদার দুই হস্ত প্রসারিত।
এক আশ্চর্য মানুষ তিনি।
দুই
জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি গালি খেয়েছি সানী ভাইয়ের কাছে। আমাকে খুঁজে না পেলেই, আমি ফোন ধরতে না পারলে, কোনো নির্ধারিত অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত না হলেই শুরু হবে সানী ভাইয়ের গালিবর্ষণ।
আমীরুল হালায় মানুষের বাচ্চা না। অর কথা আর কইবা না আমারে। ধান্দাবাজ হইয়া গেছে। কথা দিয়া কথা রাখব না। চর্বি জইমা গেছে।
আমীরুল- হালার লগে আর কথা নাই। অর ফোন আর ধরুম না।
দু-একদিন হয়তো এই গোস্বা থাকবে। তারপর আবার সানী ভাই সহজ ও স্বাভাবিক। আবার আমাদের কার্যক্রম চলতে থাকবে।
আর গালি গালাজ তো লিখিত হবে না। সানী ভাইয়ের গালির ধ্বনি ঝংকার শুনতেই ভালো লাগবে। সেসব কাগজে লেখা সম্ভব নয়।
আমার অনেক বই সানী ভাই প্রকাশ করে দিয়েছেন। শিশু একাডেমী, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের অবদান সানী ভাইয়ের। তার কল্যাণেই আমার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সানী ভাইয়ের কল্যাণে আমার বড় ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র অমির জন্য ঢাকার আশেপাশে জমি কেনা হয়েছে।
সানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সানী ভাই যদি কিছু বলেন বা আদেশ দেন সেটা পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমি কিছু বললে সানী ভাই সেটা সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সমাধা করে দেন।
সানী ভাইকে আমি বেশ কয়েকটা বই উৎসর্গ করেছি। সানী ভাইও আমাকে অনেকগুলি বই উৎসর্গ করেছেন।
বইমেলা ২০১৮ তে সানী ভাই অপরিসীম আবেগে আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। ‘আমীরুলনামা’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ছড়ার বই প্রকাশ করেছেন সানী ভাই। বইটির প্রকাশক বাদল চৌধুরী। আমাদের আরেক স্নেহভাজন। বইটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে মেলা মাঠে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বললেন: শাবাশ সানী। দুর্দান্ত কাজ করেছ। বাংলাভাষায় জীবিত কোনো অগ্রজ কোনো অনুজপ্রতি এরকম ছড়ার বই প্রকাশ করেনি।
তোমাকে অভিবাদন সানী।
সানী ভাই হাসতে হাসতে বললেন,
সব হালায় এই বই দেইখা হিংসায় জ্বলতাছে। সবার খবর হয়্যা গেছে।
আমি বললাম,
কামটা ভালো হয়নি উস্তাদ
সানী ভাই, হিংসা বাড়ায়া লাভ কী?
সানী ভাই অবশ্য কাউকে পরোয়া করেন না। যত বড় ব্যক্তি হোক না কেন- অসংগতি দেখলে তার সমালোচনা করে যাবে, কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই সানী ভাইয়ের। মন্ত্রী, এমপি, সচিব- সবার সঙ্গেই সদ্ভাব তার। স্বনামে সবাই তাকে স্নেহ করেন। ভালোবাসেন।
সানী ভাই কখনো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অকারণ সুবিধা নেয়নি। কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে তিনি দূরে থাকেন।
সানী ভাই সকল সংগঠনের প্রাণপুরুষ। সবার সঙ্গে তিনি মিলেমিশে থাকেন। মজাটা হচ্ছে সানী ভাই আর আমি এমনই মানিকজোড় যে সানী ভাইয়ের প্রিয়জনেরা আমার প্রিয়জন। আমার ঘনিষ্ঠজনেরা সানী ভাইয়েরও ঘনিষ্ঠ।
একটা কথা বলা হয়নি। আমাকে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত করে থাকেন তিনি আসলাম সানী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে থাকেন: আমীরুল আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু জ্ঞানে মেধায় আমীরুল আমার চেয়ে অনেক বড়।
আমীরুল আমার গুরু।
আমীরুলের কাছ থেকে আমাকে অনেক কিছু শেখার আছে।
যারা আমীরুলের মূল্য দিতে জানে না তাদের দিয়ে কিছু হবে না। আমীরুলকে ভ্যালু দিতে হবে।
আমি সামনে হয়তো দর্শক আসনে বসে আছি। সানী ভাই মাইক্রোফোনে অনর্গল বলে যাচ্ছেন,
আমীরুল অনেক লাজুক। নিজের আত্মপ্রচার করতে পছন্দ করে না। আরেকজন আছে ধ্রুব এষ। খামোখা এরা ছোটাছুটি করে না।
বক্তৃতার মধ্যে বলতে থাকলেন: শুধু বাংলা নয়, বিশ্ব শিশুসাহিত্যেই আমীরুল তার সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আছে।
আমি লজ্জায় মাথা নত হয়ে বসে থাকি।
ঢাকা, কলকাতা, চট্টগ্রাম, সিলেট যেখানেই হোক না কেন সাহিত্য অনুষ্ঠান সানী ভাই থাকলেই আমাকে গাছে তুলে ছাড়বে। আমি নামব কিভাবে সে উপায় থাকবে না।
সানী ভাইয়ের সাথে বিদেশ ভ্রমণ অতি আনন্দের। কলকাতায় আমরা বহুবার গেছি। একসাথে একই হোটেলে থেকেছি। ভ্রমণে সানী ভাই অসম্ভব সাহায্যকারী ব্যক্তি। আমি হার্টের রোগী। আমাকে কোনো ব্যাগ-লাগেজ বহন করতে দেবেন না তিনি। আমার প্রথম কলকাতা ভ্রমণও সানী ভাইয়ের হাত ধরে।
সানী ভাইয়ের বৃত্তান্ত বলে শেষ হবে না। পুরো একটা বই লেখার ইচ্ছা রইলো আমার।
সানী ভাই সম্পর্কে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নাট্যজন মামুনুর রশীদ কিংবা আমাদের উভয়ের অতি কাছের বন্ধু আহমাদ মাযহার সবসময় বলে থাকেন- আসলাম সানীর মতো চরিত্র আমাদের দেশে নাই। একেবারে বিরল চরিত্র। কোনো তুলনা নাই।
সানী ভাই একক ও অদ্বিতীয়। সানী ভাইয়ের মুখের হাসি যেন কোনোদিন মলিন না হয়।