আমাদের গানের জগতের উচ্চতম এক পরম পূজনীয় ব্যক্তি সুরকার-শিল্পী-গীতিকার আজাদ রহমান চলে গেলেন মাত্র কয়েকদিন আগে। এ সময়ে আমাদের সঙ্গীত জগতের যে সব প্রবীণতম ব্যক্তিত্বরা বেঁচে ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। তার প্রস্থানে আমাদের সঙ্গীত জগতের একটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র যে চিরতরে নিভে গেল তা সন্দেহাতীত। সুরকার-গায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। অনেক গানেই তিনি দিয়েছেন সুনিপূণ সুরমূর্ছনা।
বহুমাত্রিক এবং ভিন্নধর্মী সুরের কারণে তার সুরের অনেক গানই হয়েছে কালজয়ী। যে গানগুলো এখনও সুমধুরতা ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। এখনও শ্রোতাদেরকে আনমনা করে। তিনি বেতারে, চলচিত্রে গান করেছেন মৃত্যুঅব্দি। আর তাই এই অনন্য সঙ্গীতপ্রতিভা চলে গেলেও তাঁর গানগুলো যে তারই কথা বলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই কবে তিনি স্বকণ্ঠে গিয়েছিলেন ‘ভালবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানি না,’। তার মৃত্যুক্ষণে এই গান প্রতিধ্বণিত হচ্ছিল সর্বত্র।
আধুনিক বাংলা গানের সুর স্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম একজন আজাদ রহমান। সুরের ভেতরে ঢুকে ভেঙেচুরে দেখার অনন্ত ইচ্ছে নিয়ে তিনি চলেছেন সবসময়। আর তাই গানে বহুমাত্রিকতা এনেছেন। সুরে দেখিয়েছেন নতুন নতুন সৃষ্টি। তারুণ্যেই আজাদ রহমান সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একাত্তরের আগে ভারতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছবিতে। এ ছবির পরিচালক ছিলেন রবি বসু এবং দুষ্মন্ত চৌধুরী। এই ছবিতে তিনি সুরকার হিসেবে কাজ করেন সুবিখ্যাত সুবীর সেনের সাথে। এরপরপরই পশ্চিম বাংলা ছেড়ে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ বেতারে কাজ করার পাশাপাশি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজে তিনি আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। সত্তর ও আশির দশকে একাধিক সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার মধ্যে দিয়েই তিনি অসম্ভব সুখ্যাতি অর্জন করেন।
একাত্তরের আগে বাংলাদেশে এসে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি যুক্ত হন বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তক’ (১৯৬৯) ছবিতে। এই ছবিতে খুরশীদ আলমকে দিয়ে তিনি প্রথম প্লেব্যাক করান। গীতিকার আবু হায়দার সাজ্জাদুর রহমানের লেখা ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ এই গানটি তুলে দেন খুরশীদ আলমের কণ্ঠে। বাংলা আধুনিক গানের জগতে এই গানটি অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই ছবিতে মাহমুদুননবী এবং শাহনাজ রহমাতুল্লাহ’র যৌথকণ্ঠে গাওয়া ‘আমি যে কেবল বলেই চলি, তুমিতো কিছুই বলোনা’-এই গানটিও এখনও নতুন এক সজীবতা নিয়ে আছে, গানটি একটুও পুরনো হয়নি বলে মনে হয়।
একাত্তর পরবর্তীতে আজাদ রহমান ধারাবাহিকভাবে সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন- রাতের পর দিন (১৯৭৩), মাসুদ রানা (১৯৭৪), বাদী থেকে বেগম ( ১৯৭৫), এপার ওপার (১৯৭৫), মাস্তান ( ১৯৭৫), আগুন (১৯৭৫), দস্যু বনহুর (১৯৭৬), মায়ার বাঁধন (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), যাদুর বাঁশি (১৯৭৭), মতিমহল (১৯৭৭), কুয়াশা ( ১৯৭৭), ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), তুফান (১৯৭৮), সঙ্গীনি (১৯৭৯), রাজবন্দী (১৯৭৯), দি ফাদার (১৯৭৯), নতুন বউ ( ১৯৮৩), আমার সংসার ( ১৯৮৩), মায়ার সংসার ( ১৯৮৩), পাগলা রাজা (১৯৮৩), চাঁদাবাজ (১৯৯৩), দেশপ্রেমিক (১৯৯৪) এসব ছবিতে। এসব ছবির অনেকগানই সুপারডুপার হিট হয়। মেলোডিয়াস সব গানের কারণে বেশিরভাগ ছবিই ব্যবসা সফল হয়।
উল্লিখিত এসব ছবির অনেক গানই এখন কালজয়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অশোক ঘোষ পরিচালিত মাস্তান ছবিতে আব্দুল জব্বারের দরদী কণ্ঠে গাওয়া ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও’-আজাদ রহমানের সুরের এ গান এখনও প্রতিটি শ্রোতার হৃদয়ে নতুন আলোড়ন তুলে। ঐ একই বছরে মহসীন পরিচালিত আগুন ছবিতে রুনা লায়লা গেয়েছিলেন ‘মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না’। আজাদ রহমানের অনবদ্য সুরের এই গান এখনও অম্লান। চলচিত্রে তাঁর সুরের ভীষণরকম মিষ্টি মেলোডিয়াস গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-মাসুদ রানা ছবিতে তাঁরই সহধর্মিনী সেলিনা আজাদের গাওয়া ‘ মনেরই রঙে রাঙাবো, বনেরই ঘুম ভাঙাবো’, দস্যু বনহুর ছবিতে গাওয়া ‘ তুমি হলে তুমি, দূর এল কাছে,’ এপার ওপার ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘বন্ধু ওগো কী করে ভাবলে’, নায়ক রাজ্জাক পরিচালিত অনন্ত প্রেম ছবিতে খুরশীদ আলমের গাওয়া ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি,’ আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত যাদুর বাঁশি ছবিতে আহমদ জামান চৌধুরীর কথায় রুনা লায়লার কণ্ঠে গাওয়া ‘আকাশ বিনা চাঁদ হাসিতে পারেনা, সঙ্গীনি ছবিতে আব্দুল জব্বারের মায়াময় কণ্ঠে গাওয়া ‘ দুটি মন যখন কাছে এল’, দি ফাদার ছবিতে রুনা লায়লা
মাহমুদুন নবীর কণ্ঠে গাওয়া ‘ঐ মধু চাঁদ আর এই জোসনা’, নতুন বউ ছবিতে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া ‘ ও পদ্মা নদী একটু যদি সহায় হতো’, সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ আমি কপোলে পড়েছি স্বামীর সোহাগের চন্দন’, পাগলা রাজা ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া ‘বনে বনে যত ফুল আছে’, মুস্তাফিজ পরিচালিত মায়ার বাঁধন ছবিতে আহমদ জামান চৌধুরীর কথায় এম এ হামিদ এবং সেলিনা আজাদের গাওয়া প্রেম যদি লুকিয়ে রাখ তবে কেমন প্রেমিক তুমি বল’, খুরশীদ আলমের অনবদ্য কণ্ঠে গাওয়া ‘ তোমার নামে শপথ নিলাম, তোমায় আমি কথা দিলাম’, দুঃখ নেই আজাদ রহমান এবং সেলিনা আজাদের গাওয়া ‘ চিরসাথী হয়ে তুমি কাছে এলে,’ উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রের আরও কিছু গান আছে সেগুলো মেলোডিয়াস না হলেও কাহিনী নির্ভর গানগুলো এখনও সত্তর, আশির দশকের সিনেমা প্রেমিকদের মনে অন্যরকম অনুরণন তোলে। এসব গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মহসীন পরিচালিত রাতের পর দিন ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া‘ কচি ডাবের পানি দু আনা’, খুরশীদ আলমের গাওয়া ‘বলে দে বলে দে কত আর ওয়াদা করে ওয়াদা ভাঙবি, তুই মায়ের বাড়ি ছেড়ে কবে আমার বাড়ি যাবি’ অশোক ঘোষ পরিচালিত তুফান ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া ‘ও দরিয়ার পানি, তোর মতলব জানি,’ খুরশীদ আলমের গাওয়া ‘হীরার চেয়ে দামি, ফুলের চেয়ে নামী আমার নুরজাহান’, মতিমহল ছবিতে খুরশীদ আলমের গাওয়া ‘মাগো তোর চরণ তলে বেহেস্ত আমার’, আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘ওরে পান্না যৌবন তোর বৃথা যাবে দূরে থাকিস নারে’।
চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলাদেশ বেতারের জন্য অনেক আধুনিক গানে সুর করেন তিনি। সেসব গানগুলো এখনও পুরনো দিনের সঙ্গীত প্রেমিকদের নতুন ছন্দ তোলে। সিরাজুল ইসলামের কথায় খুরশীদ আলমের কণ্ঠে ‘তোমার দুহাত ছুুঁয়ে শপথ নিলাম.’ ( টেপ নং ২৪২০), আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের কথায় শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া ‘আমায় কেন মুক্ত হতে বল’, (টেপ নং ২৪১৯), আলীমুজ্জামান চৌধুরীর কথায় ‘আর নেম না অথৈ জলে সই, ডুবতে যদি না চাও এস তবে, কাজলা দিঘির কালো জলে ঐ’, (টেপ নং ২৪১৬), জেবুন্নেসা জামালের কথায় ‘কে যেনো সোনার কাঠি ছোঁয়ায় প্রাণে’, ( টেপ নং২৪১৬), আজিজুর রহমানের কথায় সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘ বউ কথা কও’ (টেপ নং ১৮৬৬), কেটি হোসেনের কথায় মাহমুদুন নবীর কণ্ঠে ‘মনতো জানে না মন চায় কী’, আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের কথায় ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘প্রিয়তম তুমি আমার,’ আজিজুর রহমানের কথায় জিনাত রেহানার কণ্ঠে ‘একটি ফুল আর একটি পাখি’, নঈম গহর এর কথায় রেবেকা সুলতানার কণ্ঠে ‘পথে আমি কুঁড়িয়ে পেলাম বাঁশি’, (টেপ নং ১৮৬৭)-এরকম আরও অনেক গান রয়েছে।
তবে সুরকারের বাইরে গায়ক হিসেবেও আজাদ রহমান অম্লান। বেতারে এবং চলচিত্রে বেশ কিছু গান গেয়েছেন তিনি। সারাজীবনে সামান্য সংখ্যক গান করলেও তার গাওয়া কয়েকটি গান এখনও শ্রোতার হ্নদয়ে অমলিন হয়ে আয়ে। স্বকণ্ঠে মাসুদ রানা (১৯৭৪) ছবিতে গাওয়া ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, এপার ওপার (১৯৭৫) ছবিতে গাওয়া ‘ভালবাসার মূল্য কত, আমি কিছু জানিনা’, ডুমুরের ফুল (১৯৭৮) ছবিতে গাওয়া ‘কর মনে ভক্ত মায়ের হাতে থাকতে দিন’-এ গানগুলো কালজয়ী।
তবে সবকিছু পেরিয়ে আজাদ রহমানের অনবদ্য হৃদয়কাড়া যে গানের সুর আমাদেরকে আরও বিমোহিত করে সেটি হলো-নঈম গহরের কথায় কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’,। আজাদ রহমানের এই গানের অনবদ্য সুরই বলে দেয়-এই দেশ, এই মাটি তার কথা বলবে সারাজীবন। সুরের তৃষ্ণায় আজীবন ডুবে থাকা এই মানুষটি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবার হৃদয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)